নোয়াখালীতে ভাটার সময় ছোট ফেনী নদীতে ভাঙছে ঘরবাড়ি

সুমন ভৌমিক, নোয়াখালী

দুই সপ্তাহে নদীপারের পাঁচ শতাধিক পরিবার ভাঙনের শিকার হয়েছে। তলিয়ে গেছে বাজার, সড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

জোয়ার ও উজানের পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে নির্মাণ করা হয় স্লুইসগেট। সাম্প্রতিক বন্যায় ভেঙে গেছে মুছাপুর স্লুইসগেটটি। আগে জোয়ারের পানি ছোট ফেনী নদী হয়ে দ্রুত নেমে যেত মেঘনায়। স্লুইসগেটটি ভেঙে যাওয়ায় ভাটার সময় নদীপারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত দুই সপ্তাহে পাঁচ শতাধিক পরিবার ভাঙনের শিকার হয়েছে। তলিয়ে গেছে বাজার, চলাচলের সড়কসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ঝুঁকিতে রয়েছে কোম্পানীগঞ্জের তিনটি ইউনিয়ন ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার কয়েক হাজার পরিবার।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, ফেনী ও কুমিল্লা থেকে নেমে আসা পানির স্রোতে সম্প্রতি ভেঙে গেছে মুছাপুর স্লুইসগেট। এটি পুনর্নির্মাণে সরকারের উচ্চ মহল থেকে পরিদর্শন করা হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন রোধেও নেয়া হয়েছে ব্যবস্থা।

মুছাপুর ইউনিয়নের জনতা বাজারসংলগ্ন এলাকার দিলমোহন দাস বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর বসবাস করছি মুছাপুরে। দুই সপ্তাহ আগে হঠাৎ আমার ঘরটি ভেঙে যায় ছোট ফেনী নদীর উজানের স্রোতে। কখনো ভাবিনি এভাবে সব হারাতে হবে। চার সন্তান, স্ত্রীসহ পরিবার নিয়ে বাঁধের পাশে বাস করছি। সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি।’

এমন অবস্থা শুধু দিলমোহনের নয়। দাস পাড়ার অন্তত ৪০টি পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। একসময় জমজমাট ছিল জনতাবাজার। সেটিও ভেঙে গেছে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে।

স্থানীয়রা জানান, গত ২৬ আগস্ট সকালে ফেনী ও কুমিল্লার বন্যার পানির স্রোতে মুছাপুর স্লুইসগেট ভেঙে যায়। আর এতেই ঘটে বিপত্তি। বর্তমানে জোয়ারে মেঘনার পানি উঠছে উজানের দিকে, আর ভাটার সময় ভাঙছে ঘরবাড়ি। মুছাপুর ছাড়াও ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে কোম্পানীগঞ্জের চর পার্বতী, চর হাজারী ও চর এলাহী ইউনিয়ন এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চর দরবেশ, চর মজলিশপুরের হাজার হাজার পরিবার ও স্থাপনা।

বাদশা মিয়া নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, ২৬ আগস্ট সকালের দিকে চোখের সামনেই স্লুইসগেটটি ভেঙে যায়। বিকালে যখন পুনরায় জোয়ার আসে, তখন ছোট ফেনী নদী হয়ে পানি ওপরে যায়। যখন ভাটা শুরু হয় তখনই দেখা দেয় ভাঙন। গত এক মাসে আশপাশের অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়েছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, বাজার, মাদ্রাসা, মসজিদ ও রাস্তাঘাট। ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে ওই এলাকার অন্তত দুই হাজার পরিবার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উজানের পানি নিষ্কাশনের লক্ষ্যে ২০০৫ সালে স্লুইসগেট নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয়, যা শেষ হয় ২০০৯ সালে। এতে ব্যয় হয় প্রায় ৩৩ কোটি টাকা। এ স্লুইসগেট ও পার্শ্ববর্তী ক্লোজার নির্মাণের ফলে কোম্পানীগঞ্জের মানুষ অনেকটাই স্বস্তিতে ছিল। জেগে উঠেছিল হাজার হাজার একর জমি। অন্যদিকে কুমিল্লা-ফেনীর মানুষও ছিল স্বস্তিতে। প্রায় প্রতি বছরই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফেনী ও কুমিল্লা। কিন্তু স্লুইসগেটটি করার কারণে ছোট ফেনী নদী হয়ে এসব পানি কোম্পানীগঞ্জের স্লুইসগেট দিয়ে দ্রুত নেমে যায় মেঘনায়। শুকনো মৌসুমে স্লুইসগেটের উজানে চাষাবাদ বেশি হয়। ১৫-১৬ বছরের মাথায় উজানের পানির চাপে কেন স্লুইসগেটটি ভেঙে গেল, সে প্রশ্ন এখন ভুক্তভোগীদের মাঝে। তাদের অভিযোগ, হয় নির্মাণে ত্রুটি ছিল, না হয় গাফিলতি ছিল রক্ষণাবেক্ষণে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

এ বিষয়ে নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেহেতু ১৫-১৬ বছর আগে এটি নির্মাণ করা হয়, তখন কোনো ত্রুটি ছিল কিনা সেটা আমি জানি না। তবে এক বছরে স্লুইসগেটটি রক্ষণাবেক্ষণে কোনো গাফিলতি ছিল না। ফেনীতে বন্যা দেখা দেয়ার পর থেকে প্রতিদিন স্লুইসগেট এলাকা পরিদর্শন করেছি। নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছি। সেখানে কোনো না কোনো প্রকৌশলী নিয়মিত ডিউটি করেছেন।’

প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সালের মতে, স্লুইসগেটটির কোনো মেয়াদকাল ছিল না। তার ওপর এ বছর অতিবৃষ্টি ও ফেনী-কুমিল্লায় ভয়াবহ বন্যার পানি স্লুইসগেটের ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এ কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে।

তিনি জানান, এরই মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এলাকাটি পরিদর্শন করেছেন। দ্রুত স্লুইসগেট নির্মাণের বিষয়ে তারা পদক্ষেপ নেবেন। তবে আপাতত ভাঙন ঠেকাতে জিও ব্যাগ ও টেকসই বাঁধ নির্মাণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ |নিয়েছেন তারা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন