অভিমত

ওয়েবসাইট, বিমানবন্দর আর অনলাইন পত্রিকা: এসব কি আমাদের সমাজের আয়না

সৈয়দ আবুল বাশার

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

আচ্ছা, কখনো কি ভেবে দেখেছেন যে আমাদের চারপাশের নানা জিনিস, যেমন ওয়েবসাইট ও বিমানবন্দর, এসব আসলে আমাদের সমাজের একটা ছোট্ট ছবি তুলে ধরে? হয়তো মনে হতে পারে এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই, কিন্তু আমার তো মনে হয় এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লুকিয়ে আছে।

প্রথমেই ধরেন ওয়েবসাইটের কথা। কিছু ওয়েবসাইট এমন যে চোখ বুজে ঘুরে বেড়ানো যায়। আবার কিছু আছে, যেখানে ঢুকলে মনে হয় বুঝি ঘোরপ্যাঁচে ঢুকে পড়লাম! আমার মনে হয়, একটা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট দেখলেই বোঝা যায় তারা কতটা সুসংগঠিত আর কার্যকর। ধরুন আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট। এটা দেখলেই আমাদের অসুস্থ ব্যাংক খাতের একটা প্রতিফলন পাওয়া যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমাদের ব্যাংক খাত অসুস্থ কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক তত্ত্বাবধানে দুর্বল, যা তাদের ওয়েবসাইটেই প্রতিফলিত হয়।

একইভাবে অনেক সরকারি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটও অনুরূপ খারাপ অবস্থায় রয়েছে। এসব ওয়েবসাইটে তথ্যের অসংগতি, পুরনো তথ্য এবং ব্যবহারকারীবান্ধব নয় এমন ইন্টারফেস দেখা যায়, যা সরকারি সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আবার অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের তথ্যে প্রবেশাধিকার (এটুআই) প্রকল্পের ওয়েবসাইট দেখুন। অন্যান্য সরকারি ওয়েবসাইটের তুলনায় এটি অনেক বেশি উন্নত এবং ব্যবহারকারীবান্ধব। এই ওয়েবসাইটে নাগরিকসেবা সহজীকরণ, ডিজিটাল উদ্ভাবন এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কিত নানা তথ্য ও সেবা পাওয়া যায়, যা দেশের ডিজিটাল রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি বহন করে।

খারাপ বা ব্যবহারে কষ্টকর ওয়েবসাইট শুধু আমাদের দেশের ব্যাপার নয়। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওয়েবসাইট দেখলে আপনি হয়রান হয়ে যাবেন। এগুলো নেভিগেট করা যেন এক মহাযুদ্ধ! এসব ওয়েবসাইটে প্রায়ই জটিল মেনু স্ট্রাকচার, অতিরিক্ত তথ্যের ভিড় এবং অপ্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল জার্গন দেখা যায়। ব্যাংক অব জাপানের ওয়েবসাইটও একই রকম জটিল, যা প্রায়ই জাপানি ভাষার জটিলতা এবং তাদের সংস্কৃতিগত প্রবণতার প্রতিফলন।

অন্যদিকে আমেরিকান ফেডারেল রিজার্ভ বা আইএমএফের ওয়েবসাইট অনেক ভালো। এগুলোয় সহজবোধ্য নেভিগেশন, পরিষ্কার তথ্যবিন্যাস এবং ব্যবহারকারীবান্ধব ইন্টারফেস দেখা যায়। এর থেকে কি বোঝা যায় না যে আইএমএফ হয়তো আমলাতান্ত্রিক, কিন্তু বিশ্বব্যাংকের চেয়ে অনেক বেশি সুসংগঠিত? এ পার্থক্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকরী ব্যবস্থাপনা এবং তাদের লক্ষ্য দর্শকদের প্রতি মনোযোগের পরিমাণ প্রতিফলিত করে।

এ ধরনের পার্থক্য শুধু ওয়েবসাইটের ডিজাইনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি প্রতিষ্ঠানগুলোর সামগ্রিক দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের প্রতিশ্রুতির একটি সূচক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

এবার আসি অনলাইন সংবাদপত্রের কথায়। এটা নিয়ে একটু বেশি কথা বলতে হবে। কারণ এখানে আমাদের দেশের অবস্থা সত্যিই উদ্বেগজনক। প্রথমত, আমাদের দেশের অধিকাংশ অনলাইন পত্রিকার ওয়েবসাইট ব্যবহার করা আনন্দদায়ক নয়। সাইটগুলো ধীরগতির, খবর খুঁজে পেতে অনেক সময় লাগে এবং ইউজার ইন্টারফেস জটিল। অথচ বিদেশী কিছু সংবাদপত্রের ওয়েবসাইট দেখুন, যেমন ধরেন নিউইয়র্ক টাইমস বা গার্ডিয়ান। কী সুন্দর সাজানো-গোছানো, কী সহজেই সব খবর পাওয়া যায়!

কিন্তু এটা শুধু দেখতে সুন্দর হওয়ার ব্যাপার নয়। এর পেছনে আরো গভীর কিছু আছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ অনলাইন পত্রিকা তথ্যের উৎস দেয় না, লিংক দেয় না। একটা খবর পড়লাম, কিন্তু এ খবরের যাচাই কোথায়? অন্য কোনো সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে কী বলছে, তা জানার উপায় কী? আবার প্রিন্ট সংস্করণে যেখানে গ্রাফ বা চিত্র দেখানো হয়, অনলাইন সংস্করণে প্রায়ই তা বাদ পড়ে যায়।

এটা শুধু পাঠকের অসুবিধার কথা নয়। এর মাধ্যমে আসলে আমাদের সাংবাদিকতার মান নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়। তথ্যের উৎস না দেয়া মানে, পাঠককে অন্ধকারে রাখা। এটা কি গণতন্ত্রের জন্য ভালো?

অথচ পশ্চিমা দেশের অনেক বড় বড় সংবাদপত্র দেখুন। প্রতিটি দাবির পেছনে তথ্যের উৎস দেয়া থাকে। পাঠক চাইলে সেই উৎস যাচাই করে নিতে পারে। তারা প্রতিবেদনে উল্লেখিত বাহ্যিক উৎসের লিংক দেয়, যা পাঠকদের আরো গভীরে যেতে সাহায্য করে। এটা শুধু স্বচ্ছতা নয়, এটা আসলে সাংবাদিকতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং পাঠকদের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ।

তাহলে প্রশ্ন হলো আমাদের দেশের অনলাইন সংবাদপত্রগুলো এমন কেন? এটা কি শুধু প্রযুক্তিগত সমস্যা, নাকি এর পেছনে আরো গভীর কিছু কারণ আছে? হয়তো এটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিফলন, যেখানে আমরা তথ্য মুখস্থ করি, কিন্তু যাচাই করতে শিখি না। হয়তো এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিফলন, যেখানে আমরা প্রশ্ন করাকে সবসময় স্বাগত জানাই না।

যা-ই হোক, আমার মনে হয় এসব নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। কারণ একটা দেশের সংবাদমাধ্যম তার গণতন্ত্রের আয়না। আর অনলাইন যুগে, এ আয়না যদি ঝাপসা হয়, তাহলে আমাদের গণতন্ত্রও ঝাপসা হয়ে যাবে।

এবার আসি বিমানবন্দরের কথায়। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কথাই ধরুন। গত কয়েক বছরে এর উন্নতি হয়েছে, কিন্তু এখনো অনেক পথ বাকি। বিদেশে গেলে দেখবেন, সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ের বিমানবন্দর যেন একেকটা শহর! সেখানে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে যাবেন, কিন্তু হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই।

কিন্তু পশ্চিমা দেশের বিমানবন্দরগুলোও কি সবসময় আদর্শ? মাদ্রিদের বিমানবন্দরটা সুন্দর, কিন্তু যেকোনো গেটে যেতে আপনাকে অন্তত আধ ঘণ্টা হাঁটতে হবে। জুরিখ বিমানবন্দরেও একই অবস্থা। অন্যদিকে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর? অসাধারণ দক্ষ লেআউট, স্পষ্ট সাইনেজ—একদম টপ ক্লাস। হংকং ও সিঙ্গাপুরের বিমানবন্দরগুলোও নিউইয়র্ক বা শিকাগোর তুলনায় অনেক বেশি যুক্তিসংগতভাবে সাজানো।

আর যদি বলতে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বিমানবন্দর? নিঃসন্দেহে প্যারিসের শার্ল দ্য গল। এর গোলাকার কাঠামো জেট ল্যাগে আক্রান্ত যাত্রীদের জন্য দুঃস্বপ্ন, আর ইংরেজি সাইনেজের অভাব (যা হয়তো ইচ্ছাকৃত) ফ্রান্সে প্রবেশের অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা তৈরি করে।

তো পরের বার যখন আপনি কোনো ওয়েবসাইটে ঢুকবেন, বিমানবন্দরে হাঁটাহাঁটি করবেন বা অনলাইনে খবর পড়বেন, একটু ভেবে দেখবেন—এগুলো হয়তো শুধু ওয়েবসাইট, বিমানবন্দর বা খবরের কাগজ নয়, এগুলো আসলে আমাদের সমাজেরই একটা ছোট্ট ছবি। আর এ ছবি যদি আমাদের পছন্দ না হয়, তাহলে হয়তো সময় এসেছে এটা বদলানোর।

সৈয়দ আবুল বাশার: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন