শিল্প অধ্যুষিত আট এলাকা

৪৬ লাখ শ্রমিকের ৫৭ শতাংশই আশুলিয়া ও গাজীপুরের

নিজস্ব প্রতিবেদক

একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিক ছবি: ফাইল/নিজস্ব আলোকচিত্রী

আট শিল্প এলাকায় কেন্দ্রীভূত দেশের বস্ত্র ও পোশাক থেকে শুরু করে মোবাইল, ফার্নিচার, চামড়াজাত পণ্যের কারখানা। শিল্প পুলিশের আওতাভুক্ত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনা, কুমিল্লা ও সিলেট। এসব এলাকায় গড়ে ওঠা কারখানায় কাজ করেন ৪৬ লাখেরও বেশি কর্মী। এর ৫৭ শতাংশই আশুলিয়া ও গাজীপুর এলাকায়। 

সাম্প্রতিক সময় এ দুই এলাকায় ব্যাপক শ্রম অসন্তোষ দেখা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বেশকিছু বন্ধও রাখতে হয়। এক পর্যায়ে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মেনে নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কারখানাগুলো চালু হয়। আগেও এ দুই এলাকায় শ্রম অসন্তোষ সবচেয়ে তীব্র আকার ধারণ করতে দেখা গেছে। আশুলিয়া ও গাজীপুরে শ্রমিকদের সিংহভাগ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার বিষয়টি এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন শিল্প মালিকরা। 

যদিও মোটা দাগে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রীভবন নয়, শ্রমিকের কর্মপরিবেশের ঘাটতি এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অভাবই শ্রম অসন্তোষের কারণ। তাদের ভাষ্যমতে, শিল্প অধ্যুষিত এলাকার কোনোটিই পরিকল্পিত না। পাকিস্তান আমলে টঙ্গী, তেজগাঁওয়ে পরিকল্পিত শিল্প এলাকা গড়ে উঠতে দেখা গেছে। এরপর ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোয় যেখানেই জমি পাওয়া গেছে, সেখানেই পোশাকসহ ও অন্যান্য শিল্প গড়ে উঠেছে। বিশেষ ঢাকা ইপিজেডের পাশে হওয়ায় আশুলিয়ায় শিল্প স্থাপন হয়েছে বেশি। অপরিকল্পিত শিল্পায়নের পাশাপাশি মৌলিক নাগরিক সুবিধার অভাব এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় এলাকাগুলোয় শ্রম অসন্তোষকে তীব্রতা দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। যেমন শ্রমিকের বেতনের নির্ধারিত কাঠামো থাকলেও কারখানাগুলোয় টিফিন, ওভারটাইম ভাতার মতো সুবিধাগুলোর কোনো মানদণ্ড নেই। আবার আশুলিয়া ও গাজীপুর এলাকার কোথাও শ্রমিকদের আবাসন, বিনোদন, চিকিৎসা, সন্তানদের শিক্ষার কোনো সুব্যবস্থা নেই। ন্যূনতম নাগরিক সুবিধার ঘাটতি নিয়ে সেখানে বসবাস করছেন তারা। শিল্প পুলিশের হিসাবে, শিল্প অধ্যুষিত আট এলাকায় মোট কারখানা আছে ৯ হাজার ৪৭৩টি। এসব কারখানার কর্মী সংখ্যা ৪৬ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে শুধু আশুলিয়া ও গাজীপুরের ৪ হাজার ৯৭টি কারখানার শ্রমিক সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার। এ অনুযায়ী মোট শ্রমিকের ৫৭ দশমিক ৩৮ শতাংশই আশুলিয়া ও গাজীপুরে।

শ্রমিক প্রতিনিধিরা বলছেন, আশুলিয়া ও গাজীপুর শিল্প এলাকায় শ্রমিকের সংখ্যা কম হলেও এখানে শ্রম অসন্তোষ হতো। কারণ, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব এলাকায় শ্রমিকদের নাগরিক সুবিধা বলে কিছু নেই। বিষয়টি নিয়ে কোনো সরকারই কখনোই মাথা ঘামায়নি। 

যদিও শিল্প মালিকরা বলছেন, শ্রমঘন এলাকা হওয়ায় এখানে সমস্যাও বেশি হয়। দেশের তৈরি পোশাক পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শ্রমঘন এলাকায় শ্রমিকদের সমস্যা সবসময় বেশি। এটা খুবই স্বাভাবিক চিত্র। কালক্রমে যারা দূরে সরে গেছেন, যেমন কোনো মালিক ঈশ্বরদী নিয়ে গেছেন কারখানা। কোনো মালিক ময়মনসিংহ চলে গেছেন। শ্রীপুরের শেষপ্রান্তে অনেকে চলে গেছেন। সেখানকার পরিস্থিতি আশুলিয়া-গাজীপুরের চেয়ে ভালো। শ্রমঘন এলাকাগুলোয় অসন্তোষের গতি বদলাতে সময় লাগে না।’ 

শিল্প এলাকাগুলোর শ্রমিকদের নাগরিক সুবিধা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আবাসন বা বিনোদন সুবিধার মতো বিষয়গুলো ব্যক্তি মালিকদের হাতে নেই। দেখা যাচ্ছে শিল্প-কারখানাগুলোর আশপাশে প্রচুর ঘরবাড়ি ও দোকানপাট গড়ে উঠেছে শুধু শ্রমিকদের থাকার জন্য। শ্রমিকদের জন্য স্থানীয়দের সুন্দর আয়ের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বিনোদনের মতো বিষয়গুলোও মালিকদের হাতে নেই। সরকার চাইলে কেন্দ্রীয়ভাবে পার্কের ব্যবস্থা করতে পারে। সরকারের কাছে সুষ্ঠু আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি আমাদের অনেক আগে থেকেই ছিল, কিন্তু হয়নি।’ 

এসব এলাকায় শিল্প-কারখানার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের অন্যান্য ব্যবস্থা থাকা দরকার বলে মনে করছেন শ্রম খাত বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, পোশাক কারখানার মালিকরা বিপুলসংখ্যক শ্রমিককে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে চাকরিচ্যুত করেছেন। কারখানাগুলোর কর্তৃপক্ষরা চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের কালো তালিকা করার একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। এ তালিকাকে তারা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এটির কারণে এক কারখানার চাকরিচ্যুত শ্রমিকরা অন্য কারখানায় চাকরি পান না। যদিও চাকরি চলে যাওয়ার পরও এ শ্রমিকদের অনেককেই সেসব এলাকায়ই বসবাস করতে হচ্ছে। 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পরিকল্পিত শিল্পায়ন ছাড়া এ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসার কোনো সুযোগ নেই। পরিকল্পিতভাবে শিল্প গড়ে তুলতে মালিক পক্ষের কয়েক দফা উদ্যোগ দেখা গেলেও পরে তা আর বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। যেমন পূর্বাচলের একটা অংশ গার্মেন্টস পল্লী হতে পারত, সেটা হয়নি। এখন যেটা অগ্রাধিকারের বিষয় হওয়া উচিত, সেটি হলো যেখানে শিল্প গড়ে উঠেছে সেখানে নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি করা। এটা জরুরি হয়ে গেছে। শ্রমিকরা ঘুরতে বের হলেও দেখা যায় রাস্তায় বসে আছে। অর্থাৎ একটা পার্কের ব্যবস্থাও নেই। কেন্দ্রীভূত একটা এলাকায় মানবেতর জীবনযাপন করেন শ্রমিকরা। এ ধরনের পরিবেশে মনের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ দানা বাধাটা অস্বাভাবিক না। মোটা দাগে শ্রমিকের কেন্দ্রীভবন অসন্তোষের জন্ম দিচ্ছে কারণ তাদের স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই। কিন্তু মূল সমস্যাগুলো কারখানার ভেতরে বিদ্যমান। ক্ষোভের মীমাংসার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সেগুলো বাইরে চলে আসে। আর ক্ষোভ কারখানার বাইরে এসে অসন্তোষের জন্ম দেয়ার একটা কারণ অপরিকল্পিত শিল্পায়ন।’

অধিকাংশ শ্রমিকের এ দুই এলাকায় কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়াকে শ্রমিক অসন্তোষের কারণ হিসেবে মানতে রাজি নন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত সচিব) মো. আবদুর রহিম খানও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকের কেন্দ্রীভবনকে অসন্তোষের কারণ বলার কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি না। বরং শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্যর পাশাপাশি অন্যান্য পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে সুন্দর শ্রম পরিবেশ দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।’ 

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের শ্রম অধ্যুষিত আশুলিয়া ও গাজীপুরে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে। কারখানা বন্ধ হয়ে বিঘ্নিত হয় উৎপাদন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার ও মালিক পক্ষের সামনে শ্রমিকরা ১৮ দফা দাবি উপস্থাপন করে। কয়েক দফা আলোচনার পর এগুলোর সবই মেনে নিয়েছে মালিক পক্ষ। 

এ ১৮ দফা দাবিতে বলা হয়, মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন করে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। যেসব কারখানায় ২০২৩ সালে সরকার ঘোষিত নিম্নতম মজুরিও এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। শ্রম আইন সংশোধন করতে হবে। কোনো শ্রমিকের চাকরি পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার পর চাকরি থেকে অব্যাহতি দিলে বা চাকরিচ্যুত হলে একটি বেসিকের সমান অর্থ প্রদান করতে হবে এবং এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক শ্রম আইনের ২৭ ধারাসহ অন্য ধারা সংশোধন করতে হবে। 

এসব দাবির মধ্যে আরো ছিল, সব ধরনের বকেয়া মজুরি অবিলম্বে পরিশোধ করতে হবে। হাজিরা বোনাস (২২৫ টাকা), টিফিন বিল (৫০ টাকা), নাইট বিল (১০০ টাকা) সব কারখানায় সমান হারে বাড়াতে হবে। সব কারখানায় প্রভিডেন্ট ফান্ড ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বেতনের বিপরীতে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ন্যূনতম ১০ শতাংশ নির্ধারণ করতে হবে। শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিজিএমইএর নিয়ন্ত্রিত বায়োমেট্রিক ব্ল্যাকলিস্টিং করা যাবে না, বায়োমেট্রিক তালিকা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সব হয়রানিমূলক ও রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। ঝুট ব্যবসার আধিপত্য বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে আইন করতে হবে। কলকারখানায় বৈষম্যবিহীন নিয়োগ প্রদান করতে হবে। জুলাই বিপ্লবে শহীদ এবং আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ এবং চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনস দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে তদন্তপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শ্রম আইন অনুযায়ী সব কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করতে হবে। অন্যায্যভাবে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে। নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ ১২০ দিন নির্ধারণ করতে হবে।

এ বিষয়ে শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার এক প্রতিনিধি বলেন, মালিকদের মেনে নেয়াই প্রমাণ করছে শ্রমিকদের দাবিগুলোর যথার্থতা ছিল।

শ্রম পরিবেশ তত্ত্বাবধানকারী সরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা মনে করেন, ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত থেকে যাওয়াটাই শ্রম অসন্তোষকে তীব্র করে তোলে। তারা জানিয়েছেন, পোশাক কারখানাগুলোয় সুযোগ-সুবিধা বা বেতন-ভাতা যা আছে, সেগুলোর নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই। কেউ টিফিন ভাতা ২০ টাকা দেয়, কেউ দেয় না। আবার কেউ ১০ টাকা কম দেয়। এ ধরনের সূক্ষ্ম কারণও শ্রম অসন্তোষকে উসকে দেয়ায় ভূমিকা রাখে। শ্রমিকের বেতন ছাড়া অন্যান্য ভাতা ও সুবিধার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মানদণ্ড না থাকাটা বড় ধরনের দুর্বলতা। দেখা যায়, টিফিন ভাতা, ওভারটাইম ভাতা—এগুলো কারখানা ও মালিকভেদে ভিন্ন হয়। তারা নিজেদের মতো এসবের পরিমাণ ঠিক করে।

জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সরকারি একটি সংস্থার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘অসন্তোষের মূলে থাকা বিষয়ের আরেকটি হলো কারখানার অভ্যন্তরে শ্রমিকদের অসন্তোষ প্রকাশের কোনো কাঠামোগত সুব্যবস্থা নেই, যার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যায়। ফলে বিষয়টি বাইরে এসে বড় অসন্তোষে রূপ নেয়। ২০১৩ সালের আইনে ওয়েলফেয়ার অফিসারের বিধান ছিল, যার দায়িত্ব হবে শ্রমিকদের অভিযোগগুলো দেখা। কিন্তু পরে দেখা গেল মালিকরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এ ওয়েলফেয়ার অফিসারদের ব্যবহার করছে। ৪৬ লাখ শ্রমিকের প্রায় ২৭ লাখই আশুলিয়া ও গাজীপুরে। এ ২৭ লাখের সঙ্গে আশপাশসহ আরো ২৭ লাখ মানুষ আছে। এখানে প্রশ্ন আসে আশুলিয়া ও গাজীপুর এলাকার অবকাঠামোগত সক্ষমতা কতটুকু। এ সবকিছু মিলিয়েই অসন্তোষগুলো হয়।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন