কৃষি ভাবনা

কৃষিকে অবজ্ঞা করে তথাকথিত শিল্পায়ন বা উন্নয়ন অভিযাত্রা হোঁচট খেতে পারে

আব্দুল বায়েস

ছবি : বণিক বার্তা

দারিদ্র্য হ্রাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির প্রভাব মূল্যায়ন করতে গেলে দারিদ্র্য হ্রাসে প্রবৃদ্ধির স্থিতিস্থাপকতা (ইলাস্টিসিটি অব গ্রোথ অন পভার্টি রিডাকশন) পর্যালোচনা করার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ গড় জাতীয় আয় যদি ১ শতাংশ বাড়ে তাহলে দারিদ্র্যের হার কী পরিমাণ কমে সেই সম্পর্কটা দেখার প্রয়াস নেয়া দরকার বলে গবেষকরা মনে করেন। এক গবেষণায় দেখা যায়, সাধারণত, উন্নয়নশীল দেশে সহগটির মান গড়পড়তা মাইনাস ২, অর্থাৎ গড়পড়তা প্রকৃত মাথাপিছু আয় ১০ শতাংশ বাড়লে দারিদ্র্যের হার কমবে ২০ শতাংশ। তা হলে পাঠক বুঝে নিন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য হ্রাসে কেন এবং কতটা গুরুত্বপূর্ণ। একটু ঘুরিয়ে বলতে হয়, তোরা যে যা বলিস ভাই, প্রবৃদ্ধি আমার চাই, বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটা দেশে। তবে বাংলাদেশে সহনীয় দারিদ্র্যের প্রবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতা সত্যি খুব কম এবং তাও ২০০৫ সাল থেকে নিম্নগামী। হিসাব কষে দেখানো হচ্ছে যে ২০১৬-২২ সময়ে সহগটির মান ছিল মাত্র দশমিক ৮ শূন্য। এর অর্থ দাঁড়ায়, বাংলাদেশে মাথাপিছু প্রকৃত আয় ১০ শতাংশ বাড়লে সহনীয় দারিদ্র্য কমে মাত্র ৮ শতাংশ (উন্নয়নশীল দেশের গড় ২০ শতাংশ)। এর বিপরীতে ২০১০-১৬ সময়ে সহগটি ছিল দশমিক ৮৪ এবং ২০০৫-১০ সময়ে দশমিক ৯৬। মোট কথা, এটা প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে সহনীয় দারিদ্র্য হ্রাসে প্রবৃদ্ধির প্রারঙ্গমতা বেশ কম এবং সেটা ১৭ বছর ধরে ক্রমাগত নিম্নমুখী হচ্ছে।

দুই.

এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো, দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষি খাতের ভূমিকা কী। ঐতিহাসিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্য কমাতে কৃষি খাত একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। কৃষি থেকে জিডিপির যে হিস্যা আসে, তা সমাজের সবচেয়ে শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে তাৎপর্যপূর্ণ আয়ের সূত্রপাত ঘটায়। তাছাড়া শুধু সরাসরি দারিদ্র্য হ্রাস নয়, পুরো অর্থনীতিতে শক্তিশালী লিংকেজ প্রভাব নিয়ে হাজির হয় কৃষি খাত। কৃষির পরোক্ষ অবদান আসে খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে, যেমন সার, সেচযন্ত্র, কীটনাশক এবং অন্যান্য উপকরণের চাহিদা সমেত ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ এবং প্যাকেজিং, পরিবহন, শিল্পজাত প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ এবং কৃষিপণ্যের বাজার সমেত ফরওয়ার্ড লিংকেজ গড়ার মাধ্যমে। এ কর্মকাণ্ডগুলো ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ঘটায় খামারবহির্ভূত খাতে যার মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় বর্ধিত কর্মসংস্থান ও আয়। যা-ই হোক, দেশ যতই সম্পদশালী হবে, দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষির প্রবৃদ্ধির ধার, খামারবহির্ভূত খাতের তুলনায় ততই কমবে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। 

প্রসঙ্গত এও বলে রাখা দরকার যে দুই বছর আগেও বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ জীবিকার জন্য মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং জিডিপিতে মাত্র ১২ শতাংশ অবদান নিয়ে শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশ নিয়োজিত কৃষি খাতে। সুতরাং কৃষি খাতকে কোনোভাবেই অবহেলা করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। যেমন একটা উদাহরণই যথেষ্ট। বিবিএসের তথ্য ব্যবহার করে দেখানো যেতে পারে যে দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষির প্রবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতার মান ২ দশমিক ২৬ অর্থাৎ ২০১৬-২২ সময়ে মাথাপিছু প্রকৃত কৃষি জিডিপি ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ দারিদ্র্য হ্রাস ঘটায়, অথচ এর বিপরীতে অকৃষি প্রবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতা হচ্ছে দশমিক ৭২, যার অর্থ অকৃষি কর্মকাণ্ডে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে দারিদ্র্য হ্রাস পায় মাত্র ৭ শতাংশের কোঠায়। মনে হয়, এমনতর পরিসংখ্যান এটা প্রমাণ করতে চায় যে অন্তত দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি অকৃষি খাতের তুলনায় তিন গুণের বেশি শক্তিশালী। অর্থাৎ বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাসে একই হারে প্রবৃদ্ধি অকৃষির চেয়ে কৃষিতে বেশি কার্যকর।

তিন.

তাহলে দেয় লিংকেজ প্রভাব সাপেক্ষে কৃষিকে আরো গতিশীল, বেগবান করা যায় কীভাবে? যাতে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাস দ্রুততর করা যায়। সম্প্রতি বেশ কয়টি বিষয় সামনে আনা যায় যা নীতিনির্ধারকদের জন্য নীতিমালা ও কৌশল প্রণয়নে চিন্তার খোরাক হতে পারে।

ভবিষ্যতে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন এমন প্রযুক্তি প্রসার করা যা উৎপাদন বাড়ায় এবং উঁচু মূল্যের ফসল, মাছ ও গবাদিপশুসহ ফসলবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে মনোযোগ আকর্ষণ করে। কৃষি খাতের দারিদ্র্য নিরসনক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে প্রযুক্তিতে ব্যক্তি ও সরকারি খাতের নজর দেয়া অত্যন্ত জরুরি। 

ক্রমহ্রাসমান চাষের জমি, ক্ষয়িষ্ণু উর্বরতা, পোকার আক্রমণে বিশেষ ফসলের ঝুঁকি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব–প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততার কথা মাথায় রেখে উৎপাদন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন সময়ের দাবি। উপরন্তু গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও খামারের মধ্যকার উৎপাদন তারতম্য কমিয়ে আনা জরুরি। 

খুব গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে কৃষিতে অর্থায়নের কথা। বিশেষত ক্ষুদ্র চাষীদের জন্য ঋণের বাজারে খুব সীমিত প্রবেশগম্যতা তাদের প্রযুক্তি প্রসারণ, জীবিকা বহুমুখীকরণ এবং পণ্য বাজারজাতের পথে বড় বাধা। তাছাড়া সময়মতো এবং ব্যয়সাশ্রয়ী উপকরণলভ্যতা তাদের লাভের মুখ দেখায়।

মোট কথা, কৃষি খাতের উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষির ভূমিকা বলিষ্ঠ করতে হলে একটা সমন্বিত পরিকল্পনার ছাতার নিচে থাকতে হবে প্রযুক্তির প্রসারণ, উঁচু মূল্যের ফসল উৎপাদনে স্থানান্তর, চলমান পুঁজির লভ্যতা যা কৃষিকে দেবে দারিদ্র্য হ্রাস করার অধিকতর শক্তি। 

বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে আধুনিকায়ন, উঁচু মূল্যের পণ্য উৎপাদন এবং ফসল বহুমুখীকরণের ওপর। বহু আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পুত্রকে লিখেছিলেন ‘অনুগ্রহ করে ওদেরকে বলো বসতভিটা ও ক্ষেতের সীমানায় যেখানে সম্ভব আনারস, কলা, খেজুর এবং অন্যান্য ফলের গাছ লাগাতে। আনারসের পাতা থেকে খুব ভালো এবং শক্ত আঁশ বের করা যায়। এ ফলটা আবার খুব সহজেই বাজারজাত করা যায়। ঝোপঝাড়ের বেড়া হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং শেকড় থেকে কীভাবে খাদ্য উৎপাদন বের করা যায় সে সম্পর্কে কৃষকদের জ্ঞান দেয়া দরকার। যদি তাদের গোল আলু চাষে উদ্বুদ্ধ করা যায় সেটা হবে খুব লাভজনক। অফিস রুমে আমেরিকান ভুট্টা আছে; দ্যাখো এগুলো বোনা যায় কিনা।’

চার.

বাংলাদেশের কৃষি নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনার কথা না বললেই নয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সত্তরের দশকের প্রায় ৩ শতাংশের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমে এলেও এখনো বছরে প্রায় ১৮ লাখ মানুষ যোগ দিচ্ছে বাংলাদেশের মানব-মহাসমুদ্রে। এ বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর অতিরিক্ত তিন লাখ টন চাল উৎপাদন বাড়াতে হবে। অন্যদিকে কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে বার্ষিক ১ শতাংশ হারে। তবে সুখবর এই যে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি সাপেক্ষে মাথাপিছু চালের ভোগের পরিমাণ কমছে বলে বাঁচোয়া। জলবায়ু পরিবর্তন চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে কৃষিতে যা মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেয়া জরুরি। সমস্যা দাঁড়িয়েছে খাবার ও খাবারবহির্ভূত পণ্য বাজারজাতে করপোরেট সেক্টরের প্রবল প্রভাব কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের উদ্বৃত্ত হ্রাস করছে। এ ধরনের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান জরুরি। খাবার এবং বিশেষত চালবহির্ভূত পণ্য উৎপাদনে গবেষণাগত এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ অত্যন্ত জরুরি। কারণ অদূর ভবিষ্যতে উন্নয়নের গতিধারা সাপেক্ষে কৃষি খাতে ধানের চেয়ে অন্যান্য ফসল ও গবাদিপশু এবং মাছ চাষের ভূমিকা বাড়বে। 

পাঁচ.

আমরা যেন ভুলে না যাই যে, এখনো কৃষি হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণ। কৃষিকে অবজ্ঞা করে তথাকথিত শিল্পায়ন বা উন্নয়ন অভিযাত্রা হোঁচট খেতে পারে। মাঝেমধ্যে ভয় জাগে কারণ—


‘‌অদ্ভুত আঁধার এক 

এসেছে পৃথিবীতে আজ

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি

আজ চোখে দ্যাখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো

প্রেম নেই প্রীতি নেই

পৃথিবী অচল আজ 

তাদের সুপরামর্শ ছাড়া’ (জীবনান্দ দাশ)।


বলা বাহুল্য জলবায়ুর পরিবর্তন, কৃষিজমির ওপর অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, নগরায়ণ, কৃষিতে করপোরেট খাতের প্রভাব, সিন্ডিকেট, উপকরণের ঊর্ধ্বমুখী এবং উৎপাদনের নিম্নমুখী দাম ইত্যাদি কৃষি খাতকে বধ করার জন্য যথেষ্ট। আমরা আশা করব, বর্তমান ও আগামী সরকারগুলো কৃষি খাতকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতি সাপেক্ষে পুরনো কৌশল ও নীতিমালা ঢেলে সাজাবে। 

আব্দুল বায়েস: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য; অর্থনীতির অধ্যাপক ও ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন