দুর্বল ব্যাংক

সংকট উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যৌক্তিক ও কার্যকর পদক্ষেপ দরকার

ছবি : বণিক বার্তা

অর্থনীতির ‘হৃৎপিণ্ড’ হিসেবে পরিচিত ব্যাংক খাত। বিগত সরকারের আমলে অনিয়ম-দুর্নীতি, ঋণ পুনঃতফসিল, অপ্রয়োজনীয় সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক অনুমোদন, ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় পরিবার বা গোষ্ঠীর প্রভাবে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এ খাতকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণের হার অসহনীয় মাত্রায় বেড়ে গেছে, বিনিয়োগ স্থবির, আমানত সংগ্রহ ও প্রবৃদ্ধির হার কোনো কোনো ব্যাংকে ঋণাত্মক। বাধ্যতামূলক ক্যাশ রিজার্ভ ও তারল্য সঞ্চিতি রাখতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক ব্যাংক। সুশাসনের অভাবে স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে খাতটি এত বেশি সমস্যার মুখোমুখি আর কখনো হয়নি। তারল্য সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত, আধা সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। এ খাতকে দুর্বল করতে বাংলাদেশ ব্যাংকও অনেকাংশে দায়ী। বিগত বছরগুলোয় এ খাতে অনেক ঘটনা চিহ্নিত হলেও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংককে। বিগত বছরগুলোয় এ খাত সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসে ব্যাংক খাত সংস্কারে দ্রুত কিছু কার্যকরী ব্যবস্থা নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক একের পর এক তাদের অধিভুক্ত তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিচ্ছে। গঠন করে দিচ্ছে নতুন পর্ষদ। শুধু সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে ভাবলেই হবে না। গ্রাহক বা আমানতকারীদের আস্থা বজায় রাখতে তারল্য প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌক্তিক ও কার্যকর পদক্ষেপ দরকার। 

সরকারকে শুধু ব্যাংক খাত সংস্কারে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না। গ্রাহক বা আমানতকারীদের আস্থা অটুট রাখতেও কাজ করতে হবে। এরই মধ্যে দেশের বেশকিছু ব্যাংকে তারল্য সংকটের কারণে গ্রাহক তথা আমানতকারীদের গভীর আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণদান তহবিলের প্রধান উৎস আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীরা তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্যই অর্থ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখেন। বর্তমানে দেশের এক ডজন ব্যাংকে তাদের গচ্ছিত মূল্যবান আমানত অরক্ষিত, চাহিবামাত্র সে আমানত তারা পাচ্ছে না অথবা না পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থার কারণে গ্রাহক বা আমানতকারীদের আস্থাহীনতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, যা মোটেই ব্যাংক খাতের জন্য ভালো দিক নয়। ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের শ্রেণী বিন্যাস করলে দেখা যাবে, সাধারণ আমানতকারীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমানতই হচ্ছে মোট আমানতের সিংহভাগ। ক্ষুদ্র কিন্তু মোট আমানতের সিংহভাগ আমানতকারীদের আমানত আকৃষ্ট করতে না পারলে আস্থার সংকট মিটবে না। আমানতকারীরা যখন তার অর্থ নির্বিঘ্নভাবে উত্তোলন করতে পারছেন না তখন তার মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে একজনের ভয় অন্য আমানতকারীকেও সংক্রমিত করছে। ফলে একসঙ্গে ব্যাংকের ওপর আমানত উত্তোলনের জন্য চাপও সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও সবার অর্থের প্রয়োজন নাও থাকতে পারে। এ আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে আমানতকারীদের ভয় দূর করতেই হবে। তা না হলে এ খাত আরো ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। এজন্য দেশের ব্যাংক খাতের সংকট গ্রাহক কিংবা আমানতকারীদের আস্থার সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্রুত পদক্ষেপ কাম্য।

যদিও তারল্য সংকট কাটাতে নয়টি ব্যাংককে দ্রুততম সময়ের মধ্যে টাকা ধার দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের অন্তত এক ডজন ব্যাংকে নগদ টাকার তীব্র সংকট চলছে। কিছু ব্যাংকের সংকট এতটাই তীব্র যে ওই ব্যাংকগুলোর ক্যাশ কাউন্টারের কার্যক্রম এক ধরনের সীমিত হয়ে পড়েছে। আমানতকারীরা এসব ব্যাংকে কেবল টাকা তুলতেই যাচ্ছেন। কেউ জমা দিচ্ছেন না। আবার টাকা তুলতে না পেরে বেশির ভাগ গ্রাহকই ব্যাংক থেকে ফেরত যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্যাংকগুলোকে এ অবস্থা দ্রুত কাটিয়ে ওঠা জরুরি। সেজন্য শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিতের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ, পরিবীক্ষণ আরো সুদৃঢ় করতে হবে। সংস্কারের পাশাপাশি আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতেও এখন কার্যকর উদ্যোগ দরকার। 

দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকের তারল্য সংকট মেটাতে সচ্ছল ব্যাংক থেকে কিছু আমানত সেই ব্যাংকে স্থানান্তর করার যে উদ্যোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়েছে সে বিষয়টি সাময়িক সমাধান হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি কোনো সমাধান নয়। অন্যান্য ব্যাংক নিশ্চয়ই দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদে আমানত রাখবে না। দীর্ঘমেয়াদে আমানত রাখতে গেলে যে ব্যাংক আমানত রাখবে তাদেরও তারল্য সংকটে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সংকটে থাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য ঋণপত্র বিক্রির অনুমোদন ও ব্যবস্থা নিতে পারে। সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, হাসপাতালে সেবাপ্রতিষ্ঠানের বিল, বাট্টা ফি আদায়ের অনুমোদন দিতে পারে। 

ব্যাংক খাতে বিরাজমান অস্থিরতা—ঋণখেলাপি, ঋণ পুনঃতফসিল, তারল্য সংকট, ব্যাংক একীভূতকরণ প্রভৃতি কারণে এ খাতের প্রতি আমানতকারীসহ সাধারণ মানুষের ক্রমান্বয়ে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। ফলে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকা রাখার চাহিদা বেড়েছে। বর্তমানে টাকা উত্তোলনে নানা হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে গ্রাহককে। যদিও ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতিও নগদ অর্থের চাহিদা বাড়ার একটি কারণ।

আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসে ২০০৯ সালে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সে সময় দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ শতাংশ। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, এটিই খেলাপি ঋণের পুরো চিত্র নয়। লুকানো খেলাপি ঋণ বরং এর চেয়ে অনেক বেশি। অবলোপন, আদালতের স্থগিতাদেশ, বিশেষ নির্দেশিত হিসাবে থাকা অর্থ ধরলে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ হবে সাড়ে ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ কোটি টাকা।

যে দেশের অর্থনীতি যত বেশি সুসংহত, সে দেশে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা ব্যাংকের সংখ্যা তত কম। এক্ষেত্রে আমরা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার দিকে তাকালে দেখতে পাই যে তাদের অর্থনীতির আকার বেড়েছে। একই সঙ্গে অর্জন করেছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। অর্থনীতির আকার বিবেচনায় সেসব দেশে স্থানীয় ব্যাংকের সংখ্যা বাড়েনি। এসব দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ায় সেখানে বিদেশী ব্যাংকগুলোর আকর্ষণ বাড়াচ্ছে। থাইল্যান্ডের জিডিপির আকার ছাড়িয়েছে ৫০০ বিলিয়ন ডলার। দেশটিতে সরকারি খাতে মাত্র ছয়টি এবং বেসরকারি খাতে মাত্র ১২টি ব্যাংক। অর্থাৎ সব মিলিয়ে দেশটিতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত নিজস্ব ব্যাংকের সংখ্যা ১৮। এশিয়ার অন্যতম ধনী দেশ সিঙ্গাপুরে স্থানীয় ব্যাংকের সংখ্যা মাত্র পাঁচ। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ মালয়েশিয়ায় স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা ব্যাংক মাত্র আটটি। অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ায় প্রতিনিয়ত দেশগুলোয় বিদেশী ব্যাংকগুলো শাখা খুলছে। থাইল্যান্ডে ৪৫টি, সিঙ্গাপুরে ২২টি ও মালয়েশিয়ায় ২৬টি বিদেশী ব্যাংক। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতেও আমাদের চেয়ে ব্যাংকের সংখ্যা কম। দেশটিতে ১২টি সরকারি ও ২২টি বেসরকারি ব্যাংক রয়েছে। তবে ভারতে অঞ্চলভিত্তিক ৪৩টি ব্যাংকের পাশাপাশি ৪৬টি বিদেশী ব্যাংকও কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফিলিপাইনে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১৭টি ব্যাংক। তবে ফিলিপাইনে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ২৯টি বিদেশী ব্যাংক। কিন্তু এসব দেশের তুলনায় ব্যাংক খাতে বাংলাদেশের চিত্র পুরো উল্টো। বর্তমানে দেশে তফসিলভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৬২। এর মধ্যে বিদেশী ব্যাংক নয়টি। তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংকসহ দেশে মোট নয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক আছে। একটি ডিজিটাল কমার্শিয়াল ব্যাংক। বাকি ৪৩টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে। 

অর্থনীতির আকারের তুলনায় বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। ২০০৯ সালের পর আওয়ামী সরকার রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী বিবেচনায় প্রতিনিয়তই নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিয়ে ব্যাংক খাতটিকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শীর্ষ পদগুলোয় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়। পরিচালনা পর্ষদে সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বেড়ে যায়। ফলে ব্যাংক খাতে অস্থিরতার পাশাপাশি অনাদায়ী ঋণ ও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ব্যাংক খাতের এ নাজুক পরিস্থিতিতে নতুন করে কোনো বিদেশী ব্যাংকও দেশে আসেনি। আশির দশকে যেসব বিদেশী ব্যাংক দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করত, তারাও নিজেদের গুটিয়ে নেয়। 

বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা ও নিয়মনীতি কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ করে ফেলেন রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া গভর্নররা। ফলে দেশ ও গ্রাহকের স্বার্থ গুরুত্ব না দিয়ে তারা রাজনৈতিক স্বার্থে নোট ছাপানো ও সরকারকে ঋণ দেয়াসহ একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে থাকেন। ফলে পুরো ব্যাংক খাত নাজুক হয়ে পড়ে। সরকারকে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ দেয়ায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ সংকোচনে কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। এ খাতে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া গ্রাহক বা আমানতকারীদের মধ্যে যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে তা ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককের যৌক্তিক ও কার্যকর পদক্ষেপের প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন