সংস্কার

বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার আনতে জনগণের করণীয়

ড. মো. আব্দুল আলীম

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় পুলিশের সব লোকই ছাত্র-জনতার এ গণ-অভ্যুত্থানে সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। এটা হয়তো কিছুটা সত্য। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি কিছুসংখ্যক পুলিশ আছেন যারা ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন, অন্তত মানসিকভাবে হলেও তারা ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন। তবে তারা কিছু করতে পারছিলেন না। এর জন্য শুধু পুলিশ প্রশাসন একা দায়ী নয়। বিগত কয়েক দশক আমরা যে অসৎ ও দুর্নীতিপরায়ণ সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়েছি, এটা তার ফসল। আর এর ফলে শুধু পুলিশ নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টর দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ধ্বংস হয়েছে। আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয় ধ্বংস করা হয়েছে, যাতে করে দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র পরিচালনাকারী ব্যক্তিরা তাদের দুর্নীতি করার পথ খোলা রাখতে পারে। 

আমরা লক্ষ করলে দেখব, বিগত কয়েক দশকে আমাদের রাষ্ট্রের সব অঙ্গসংগঠন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এখানে বাদ নেই কেউ। আমাদের দেশের প্রতিটি মন্ত্রণালয় দুর্নীতিগ্রস্ত। কারণ ওই মন্ত্রণালয়ের প্রধান যে মন্ত্রী, তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত। আবার সেই মন্ত্রী তার দুর্নীতি ঠিকঠাক চালিয়ে নেয়ার জন্য ওই মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের প্রাধান্য দেন। একইভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদেরকেই বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে প্রমোশন/নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ফলে প্রমোশনের একটা প্রধান নির্ণায়ক হচ্ছে কে কত বেশি দুর্নীতি করতে পারে, আর কে কত বেশি সরকারপ্রধানের পদলেহন করে তার ইচ্ছা চরিতার্থ করতে পারে। ফলে প্রতিটি জায়গায় দুর্নীতি করার প্রতিযোগিতা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। এর প্রধান কারণ দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, ন্যায়বিচারকে নিজের স্বার্থে জলাঞ্জলি দেয়া। 

অন্যদিকে যেহেতু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরাসরি পুলিশ জড়িত, তাই আমাদের ক্ষোভ পুলিশ প্রশাসনের ওপর বেশি। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে মাঠ পর্যায়ের কোনো পুলিশ তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হুকুমের/আদেশের বাইরে গিয়ে খুব বেশি কিছু করতে পারবেন না, টিকে থাকতে পারবেন না তার চাকরিতে। তাই তাকে অনেক ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও অন্যায় কাজ করতে হয়। এভাবে কাজ করতে করতে একটা সময় এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। অনেকে আবার স্বপ্রণোদিত হয়ে আরো বেশি অন্যায় কাজে লিপ্ত হয় নিজস্ব অর্থনৈতিক লাভের আশায়। তাহলে এর থেকে আমাদের পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নেই? আছে, অবশ্যই আছে। 

এক. আমরা জন্মগতভাবেই অস্থির প্রকৃতির। কিন্তু আমাদের একটু স্থির হওয়ার চেষ্টা করতে হবে, একটু ধৈর্যশীল হতে হবে। আমরা এখন বর্তমানে একটা সংকটময় পরিস্থিতিতে আছি। এ অবস্থায় পুলিশ তার ভুল কৃতকর্মের জন্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এজন্য পুলিশের পোশাক পরিধান করে তারা কাজে আসতে ভয়ও পাচ্ছেন। এ তথ্য আমি ব্যক্তিগতভাবে পুলিশের কাছ থেকে শুনেছি। আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সাধারণ জনগণকে একটু সময় দিতে হবে যেন আমাদের পুলিশ বাহিনীতে পেশাদারত্ব ফিরে আসে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, সব মানুষের মধ্যেই শুভবুদ্ধি আছে। আর সেটা সবার ভেতর একই সময়ে জাগ্রত হয় না, কেউ কেউ এটা জন্ম থেকেই লালন করতে থাকে, কারো কারো ক্ষেত্রে এটা জাগ্রত হতে কিছু দিন, কিছু মাস, এমনকি কোনো কোনো সময় বছরের পর বছর লেগে যায়। এক্ষেত্রে আমাদের ধৈর্যের সঙ্গে সময় দিতে হবে। অন্যদিকে এখান থেকে পরিত্রাণের অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে, প্রতিটি প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিকে যোগ্য এবং সৎ হতে হবে। সর্বক্ষেত্রে যোগ্যতা এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে নিয়োগ/পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। 

দুই. আমরা যারা সাধারণ জনগণ, তাদেরও একটা দায়িত্ব আছে। পুলিশকে বিশ্বাস করাতে হবে, সাধারণ জনগণ তাদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ নয়। আর আমাদের দায়িত্ব নিয়ে তাদের কাজে ফেরার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, দিন শেষে এ পুলিশ বাহিনীই আমাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। পুলিশ নিরাপত্তাহীনতায় থাকলে আমাদের নিজেদের নিরাপত্তাই হুমকির সম্মুখীন হবে। তাই পুলিশকে জনবান্ধব হতে তাদেরকে উৎসাহিত করুন। সাধারণ জনগণকে বুঝতে হবে সব পুলিশ একই রকম নয়। এদের ভেতর অনেকেই অনেক ত্যাগ স্বীকার করে তার সততা বজায় রেখেছেন, অনেকেই ওপর মহলের আদেশে বাধ্য হয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তাই তাদের আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজে ফেরার জন্য একটু সময় দিতে হবে। সেই সঙ্গে ওপর মহলের কর্মকর্তাদেরও শুভবুদ্ধির উদয় হতে হবে। যদি কেউ কোনো পুলিশকে তার অন্যায় কাজকর্মের জন্য শনাক্ত করতে পারেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিন। এটা সমাজের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না, অন্যায়ের সঙ্গে কোনো আপস নয়। কিন্তু কখনই প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যাবে না। আর বাংলাদেশ সরকার যদি দুর্নীতিগ্রস্ত সব পুলিশ ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অতি দ্রুত বিচারের মাধ্যমে সাজা নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে সেটা সাধারণ জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে। 

তিন. পুলিশদের সব দুর্নীতি থেকে মুক্ত হয়ে জনগণের বন্ধু হয়ে ন্যায়ের পক্ষে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। আপনার চোখের সামনে অনেকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিয়েছে—আবু সাইয়িদ, মুগ্ধসহ সব শহীদ কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের জীবন বিলিয়ে দিল। তাদেরও সেখান থেকে নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে জনগণের জানমালের রক্ষায়, ন্যায়ের জন্য নিজের জীবন বাজি রাখতে হবে কোনো সরকারের অন্যায় স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়। পুলিশ যদি সাহস নিয়ে এগিয়ে আসে ন্যায়ের জন্য, তাদের দেখে অন্যরাও এগিয়ে আসবেন। মনে রাখা জরুরি, ভয়ের মতো সাহসও একজন থেকে অন্যজনে সঞ্চারিত হয়। তাই পুলিশদের জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে, জনগণের বন্ধু হতে হবে, আর এজন্য তাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাঠে নামতে হবে, এ দায়িত্ব নিতে হবে। পাশাপাশি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে যেন তাদের বন্দুকের একটি গুলিও সাধারণ জনগণের জীবননাশের কারণ না হয়। বন্দুক থেকে একটি গুলিও যেন অন্যায়ের পক্ষে বের হয়ে না যায়। তখন কর্মফলই নির্ধারণ করে দেবে পুলিশ জনগণের বন্ধু নাকি শত্রু। আমরা সব জনগণ চাই পুলিশ আমাদের বন্ধু হিসেবে মাঠে থাকুক। কিন্তু বিগত জুলাই-আগস্ট পরিস্থিতিতে তারা সেই আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ আস্থা তাই তাদেরই ফিরিয়ে আনতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের পুলিশ বাহিনী তাদের ন্যায়নিষ্ঠ কর্মের মাধ্যমে অতিদ্রুত জনমনে সে আস্থা ফিরিয়ে আনবে। আসুন আমরা সবাই যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে আসি। যে পথ দেখায় সে থাকে এগিয়ে। আর তাই আসুন, বিজয়ের এ সন্ধিক্ষণে পারস্পরিক সম্মানবোধ জাগ্রত করে, আমরা ন্যায়ের জন্য একে অন্যের চেয়ে এগিয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই। এভাবে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার দ্বারা নতুন এক বাংলাদেশের অভ্যুদয় হবে। 

ড. মো. আব্দুল আলীম: পোস্টডক্টরাল গবেষক, আলবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়, ডেনমার্ক ও অধ্যাপক (ছুটিতে), ইসিই ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন