এডিবির পূর্বাভাস

শিগগিরই কমছে না মূল্যস্ফীতি প্রবৃদ্ধি ৬.৬ থেকে কমে হবে ৫.১%

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। একই সঙ্গে দেশে চলমান মূল্যস্ফীতিও শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে আসবে না বলেও আশঙ্কা করছে সংস্থাটি। সংস্থাটির গতকাল প্রকাশিত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকের সেপ্টেম্বর সংস্করণে এ পূর্বাভাস দেয়া হয়। 

এতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ কমিয়ে ৫ দশমিক ১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে এডিবি। এর আগে এপ্রিলের পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হবে। এ অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে সংস্থাটির পূর্বাভাস সংশোধন করে কমানো হলো ১ দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট। 

এর আগে গত এপ্রিলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নেমে আসতে পারে। কিন্তু এখন এডিবি বলছে, মূল্যস্ফীতি শিগগিরই কমছে না। বরং তা উন্নীত হতে পারে ১০ দশমিক ১ শতাংশে। অর্থাৎ দেশের চলমান মূল্যস্ফীতির বর্তমান ধারা বজায় থাকবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। এডিবির বক্তব্য হলো গত জুলাই ও আগস্টে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক বন্যার প্রভাব। এ দুইয়ের সম্মিলিত প্রভাবে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে আসবে। 

এ বিষয়ে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, রাজস্ব ও আর্থিক নীতির কঠোরতা অব্যাহত থাকবে। এছাড়া ক্রয় ও বিনিয়োগ আরো কমবে। নেতিবাচক ঝুঁকি থাকায় সামষ্টিক অর্থনীতির পূর্বাভাস অত্যন্ত অনিশ্চিত। এসব ঝুঁকির উৎস হলো চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ভঙ্গুর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও আর্থিক খাতের দুর্বলতা। 

এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক অর্থনীতির ধীরগতি ও অন্যান্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে দেশে চাহিদা কমবে বলে মনে করছে এডিবি। সংস্থাটির এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে বলা হয়, পণ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়নে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে মূল্যস্ফীতি, যা আবার দুই অংকের ঘরে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। তবে আমদানি-রফতানি কমায় চলতি হিসাবের ঘাটতি কমেছে। 

রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, সুদ ও টাকার বিনিময় হার যথাযথ নীতির মাধ্যমে স্থিতিশীল করা এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের ওপর সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করবে বলে মনে করছে এডিবি।

ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক হিসাবের ওপর চাপ, আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও বেসরকারি বিনিয়োগের ধীরগতির কারণে গত দুই অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশের নিচে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ; ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ।

শেখ হাসিনা সরকারের পূর্বাভাস ছিল, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলমান চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদরা একে ‘উচ্চাভিলাষী ও বাস্তবসম্মত নয়’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। গত সরকারের আমলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ উচ্চ প্রবৃদ্ধিকে অর্থনীতিতে বড় সাফল্য হিসেবে দেখিয়েছে। কিন্তু কভিড শুরুর পর থেকে প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের বেহাল দশা শুরু হয়। একই সঙ্গে তৎকালীন সরকারের দেখানো পরিসংখ্যানের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।

দুই বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। সীমিত আয়ের মানুষকে চড়া দামে বাজার থেকে পণ্য কিনতে হচ্ছে। গত জুলাইয়ে দেশের মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘর ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, জুলাইয়ে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা গত এক যুগে সর্বোচ্চ। আগস্টে এ হার কিছুটা কমেছে। কিন্তু তা ১০ শতাংশের ওপরেই রয়ে গেছে। এ সময় খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ১১ শতাংশের মতো।

এছাড়া গত জুন পর্যন্ত আগের এক বছরের প্রতি মাসেই মূল্যস্ফীতির হার ছিল সাড়ে ৯ শতাংশের আশপাশে। এ উচ্চ মূল্যস্ফীতিকেই এখন অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। 

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন কয়েকজন উপদেষ্টা। সে আলোকে কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার। সামনে তা আরো বাড়বে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। 

অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, প্রবৃদ্ধি হয়তো কিছুটা কমবে। আর মূল্যস্ফীতি কমতেও সময় লাগবে। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি হ্রাসে ব্যাংকের নীতি সুদহার বৃদ্ধিসহ সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এসব পদক্ষেপের প্রভাব বাজারে পড়তে কিছুটা সময় লাগবে। বাজার ব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে খুব দ্রুত মূল্যস্ফীতি নামিয়ে নিয়ে আসার কথা ভাবলেও সেটা হয়তো হবে না। আর প্রবৃদ্ধি কিছুটা স্তিমিত হয়ে ৫ শতাংশের আশপাশেই থাকবে। কারণ দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যক্তি খাত এখনো স্বস্তির স্থানে পৌঁছেনি। তাই এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। আবার সরকারি বিনিয়োগ বা এডিপিতেও কিছুটা কাটছাঁট করা হবে। তবে কিছুটা কম প্রবৃদ্ধি হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে অর্থনীতিকে বেগবান করা যাবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এলে পরে উচ্চতর প্রবৃদ্ধির দিকে যাওয়া যাবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন