খোঁজা হয় না খাদ্যদূষণের মূল কারণ

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে উৎপত্তিস্থলকে গবেষণায় প্রাধান্য দিতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য উপাদান খাদ্য। আবার উপাদানটি যদি অনিরাপদ হয় তাহলে তা নানা রোগব্যাধি ও মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশের মানুষকে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। বিএফএসএ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও মানুষের নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার এক প্রকার খর্বিত হয়েছে। বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত কোনো গবেষণায়ই খোঁজা হয়নি খাদ্যদূষণের মূল কারণ। অর্থাৎ উৎপাদন পর্যায় অনিরাপদ খাদ্য তৈরির মূল জায়গা কিনা তা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে না। বাজার থেকে নমুনা নিয়েই সম্পন্ন করা হয়েছে একাধিক গবেষণা।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সোমবার আয়োজিত এক সেমিনারেও বিশেষজ্ঞ আলোচকরা এ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তাদের প্রশ্ন, সরকারি বিভিন্ন সংস্থাই মনিটরিং ডাটা নিয়ে গবেষণা করে যেগুলো হাতের নাগালেই থাকে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কেন খাদ্যদূষণের উৎপত্তিস্থল নিয়ে গবেষণা না করে একই বিষয়ে কেন বারবার গবেষণা করছে?

বিষয়টি স্বীকার করছে বিএফএসএ কর্তৃপক্ষও। সোমবারের সেমিনারেই তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অনিরাপদ খাদ্যের মূল কারণ নিয়ে গবেষণার জন্য তাদের আরো বেশি বরাদ্দ প্রয়োজন। কারণ বর্তমানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সুবিধা ব্যবহার করে গবেষকরা অল্প টাকায় গবেষণাগুলো করে দিচ্ছেন। এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর সংস্থাটি গবেষণার প্রাক-অবহিতকরণ সেমিনারে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ১০ জন বিজ্ঞানীকে গবেষণার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে। বর্তমানে ১০টি গবেষণায় অর্থায়ন করা হচ্ছে।

নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বিশ্বে প্রতি বছর খাদ্যবাহিত রোগে ৪ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ভেজাল খাদ্য। উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানো অব্দি খাদ্যে বিষাক্ত ভারী ধাতু যুক্ত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইমপ্যাক্টের বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা সূচক ২০২২ অনুযায়ী, গুণমান ও নিরাপদ বিবেচনায় বিশ্বের ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম। এ সূচকে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের অবস্থান ৬৫তম এবং ভারতের অবস্থান ৬৭তম। অর্থাৎ বাংলাদেশের খাদ্য প্রতিবেশী দেশের খাদ্যের তুলনায় অনেক বেশি অনিরাপদ।

দেশে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি বিকল, লিভারে সমস্যা, হৃদরোগ, স্নায়ু অকার্যকর হওয়া ও উচ্চ রক্তচাপের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের প্রকোপ বেড়েই চলছে। এমনকি দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মারা যাচ্ছে এসব দীর্ঘমেয়াদি বা অসংক্রামক রোগে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব রোগ অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণকেই নির্দেশ করে। এরই মধ্যে একাধিক গবেষণায় মুরগির মাংস ও মাছে সিসা, ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়ামের মতো বিষাক্ত ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেলে মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (টিএফএ) রয়েছে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, এর মাত্রা ১ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়। সম্প্রতি বিএফএসএ আম, লিচু, বরই ও পেয়ারার প্রতিটির ৮০টি করে মোট ৩২০টি নমুনা পরীক্ষা করে। পরীক্ষা শেষে ৩৯টি নমুনায় কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি খুঁজে পায়, যা মোট নমুনার ১২ দশমিক ১৯ শতাংশ। তবে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে (১৮ দশমিক ৮ শতাংশ) রাসায়নিক পাওয়া গেছে লিচুতে, যা খুবই উদ্বেগজনক।

অনিরাপদ খাদ্য একদিকে যেমন শারীরিক ঝুঁকি বাড়ায়, অন্যদিকে জনগণের ওপর আর্থিক চাপও বাড়ায়। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল ও সংকটময় অর্থনীতির দেশে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার অর্থই হলো মানুষের চিকিৎসা বাবদ পকেট ব্যয় বৃদ্ধি। শেয়ারআমেরিকার তথ্যমতে, অনিরাপদ খাদ্য থেকে দুই শতাধিক অসুখ হতে পারে। এতে উৎপাদনের ক্ষতি ও চিকিৎসা ব্যয় বাবদ সারা বিশ্বে বছরে ১১ হাজার কোটি ডলারের বেশি ক্ষতি হয়। সুতরাং সুস্বাস্থ্য ও আর্থিক নিরাপত্তা বিবেচনায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। বিএফএসএকে এ বিষয়ে তৎপর হতে হবে। নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও সম্ভব নয়।

বিএফএসএর ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যানুসারে তাদের প্রধান কাজ হলো বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা। এজন্য প্রয়োজন খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ ও বিক্রয়সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ, পরিবীক্ষণ ও নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার কার্যাবলির সমন্বয় সাধন করা। সুতরাং তাদের অবশ্যই উৎপাদন পর্যায়ে বিশেষ নজরে রাখতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে এ জায়গা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বিএফএসএর সীমাবদ্ধতাগুলো পর্যালোচনা করা জরুরি। গবেষণা যেন সুষ্ঠুভাবে হতে পারে সে পরিবেশ সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে বিএফএসএকে গবেষণাকাজে সহযোগিতা করা আবশ্যক, যেন তারা সব ধরনের তথ্য ব্যবহার করে গবেষণা পরিচালনা করতে সমর্থ হয়। অর্থাৎ বিএফএসএর সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

মানুষের নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ একটি মৌলিক অধিকারও বটে। এজন্য বিএফএসএকে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের তদারকিও জোরদার করতে হবে। এছাড়া ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে যে বিশেষ আইন প্রণীত হয়েছিল, সেটির যথাযথ প্রয়োগও জরুরি। খাদ্য উৎপাদন ও প্রস্তুত এবং বিপণন পর্যায়ে যুক্ত সবার নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি সচেতন হতে হবে ভোক্তাকে। ‘কী খাচ্ছি’ সে প্রশ্ন সম্পর্কে সজাগ ও সম্যক জ্ঞান ভোক্তার থাকা আবশ্যক। ভোক্তা যদি সচেতন থেকে খাবার কেনা ও গ্রহণ-বর্জন করতে পারে তাহলে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে অনিয়ম প্রতিহত করার পথ অনেকটাই সহজ হবে বলে আশা করা যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন