ঢাকায় বৈধ বাসের চেয়ে অবৈধই বেশি

নিয়ন্ত্রণে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া হোক

ছবি : বণিক বার্তা

ঢাকায় গণপরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলায় অতিষ্ঠ নগরবাসী। অবৈধ, অনুমোদনহীন ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন অবাধে চলাচল ও ব্যস্ত সড়কে যত্রতত্র থামানোর কারণে অসহনীয় যানজট ও দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে যাত্রীদের। এমনকি প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। গণপরিবহন খাতের এ  বিশৃঙ্খলা দীর্ঘদিনের অনিয়মের ফসল। এজন্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা যেমন দায়ী, তেমনি সরকারও সমানভাবে দায়ী। অতীতের রাজনৈতিক দলগুলোই পরিবহন মালিকসহ খাতসংশ্লিষ্টদের নানা ধরনের অনিয়ম করার সুযোগ করে দিয়েছে। বাস মালিকরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের প্রভাবেই চলছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তাদের স্বার্থে একপেশে ও একচেটিয়া সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। আইন কার্যকরে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও দুর্বলদের ওপর আইন ঠিকই প্রয়োগ হচ্ছে। এসব কারণেই ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরে যানবাহন ব্যবস্থাপনার চিত্রটি এত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। রুট পারমিটবিহীন, ফিটনেসবিহীন, লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলো ঢাকায় চলাচলের জন্য কোনোভাবেই উপযোগী নয়। অথচ কর্তৃপক্ষের সামনে দিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করছে। পরিবহন খাতটি সেবা খাত হিসেবে গড়ে তুলতে ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থাটি পুরোপুরি ঢেলে সাজানো দরকার। সেজন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষসহ (বিআরটিএ) সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে সবার জন্য সমানভাবে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। 

বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার শাহবাগ মোড় দিয়ে প্রতিদিন ১ হাজার ২২৫টি বাস চলাচল করে, যার মধ্যে ৬৫৫টিই অবৈধ। একইভাবে মতিঝিল দিয়ে চলাচল করা ৫৭৫টি বাসের মধ্যে ২৬২টি অবৈধ, মহাখালী দিয়ে চলাচল করা ১ হাজার ৯৪টির মধ্যে ৫১৪টি অবৈধ, ফার্মগেট দিয়ে চলাচল করা ৬৪৯টির মধ্যে ৩৪২টি অবৈধ, বাড্ডা-রামপুরা দিয়ে চলাচল করা ১ হাজার ২৮৩টির মধ্যে ৬৩৩টি অবৈধ, আজিমপুর দিয়ে চলাচল করা ৪১২টির মধ্যে ২৬১টি অবৈধ, যাত্রাবাড়ী দিয়ে চলাচল করা ৭৫৪টির মধ্যে অবৈধ ৪৫০টি এবং মিরপুর দিয়ে চলাচল করা ৬৫৭টি বাসের মধ্যে ৪৩৩টিই অবৈধ। ঢাকায় এসব অবৈধ বাস পরিচালনা করছে মূলত অর্ধশতাধিক পরিবহন কোম্পানি।

দেশের পরিবহন খাতে বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যার মধ্যে অবৈধ যানবাহনের অবাধ চলাচল এখন সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। দেশের সড়ক ও মহাসড়কগুলোয় দিন দিন অবৈধ পরিবহনের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, যা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব অবৈধ পরিবহনের কারণে ঝুঁকি বাড়ার সঙ্গে সড়ক ও মহাসড়কে নিরাপত্তাহীনতাও বাড়ছে। দেশের সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর মিছিল থামছে না। বরং দিনের পর দিন তা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সড়ক নিরাপত্তা বিধানে সরকার জনস্বার্থে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে থ্রি-হুইলার অটোরিকশা, অটো, টেম্পো এবং সব শ্রেণীর অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে নিষিদ্ধ করেছিল। এরপর পেরিয়ে গেছে সাড়ে নয় বছর। মহাসড়কে তিন চাকাসহ স্বল্প গতির যানবাহন চলাচল বন্ধে উচ্চ আদালতেরও রয়েছে কঠোর নির্দেশনা। অথচ কিছুই মানা হচ্ছে না। ফলে অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটছে না। মহাসড়কে অবৈধভাবে এসব অবৈধ যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ঝুঁকিপূর্ণ এবং অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে এসব যানবাহন চলাচল করছে, যেসব কারণে প্রায় দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে। এদিকে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বিভিন্ন সময় অদক্ষ চালক, ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চালানো, অতিরিক্ত গতিসহ নানা বিষয় উঠে আসে। তবে সড়ক দুর্ঘটনার যতগুলো কারণ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে প্রায়ই দেখা যায় অবৈধ বা অননুমোদিত যানবাহনের বিষয়টি। বিশেষজ্ঞদের মতে, অবৈধ বা অননুমোদিত ইনফরমাল ট্রান্সপোর্ট বলতে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াও যে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলে সেগুলোকে বোঝায়। এ ধরনের যানবাহন চলাচলে যেহেতু কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন থাকে না, সেহেতু এসব যানবাহনে কাঠামোগত ত্রুটি ও দুর্বলতা, নিরাপত্তার ঘাটতির মতো বিষয়গুলো থেকেই যায়। 

বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ বর্তমানে ২০ ধরনের যানবাহনকে রাস্তায় চলাচলের অনুমোদন দিয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স, অটোরিকশা, অটো টেম্পো, বাস, কার্গো ভ্যান, কাভার্ড ভ্যান, ডেলিভারি ভ্যান, হিউম্যান হলার, জিপ, মাইক্রোবাস, মিনিবাস, মোটরসাইকেল, পিকআপ, প্রাইভেট কার, স্পেশাল পারপাজ ভেহিকল, ট্যাংকার, ট্যাক্সি ক্যাব, ট্রাক্টর, ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহন। বিআরটিএর তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এ ২০ ক্যাটাগরিতে দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৬১ লাখের বেশি। দেশের সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ অনুযায়ী, এসব ক্যাটাগরির যানবাহন ছাড়া সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করা সব ধরনের যানবাহন অবৈধ। আর অবৈধভাবেই এ ধরনের যানবাহন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সড়ক-মহাসড়কে, যার কারণে সড়কে তৈরি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি। 

ঢাকার রুটে অবৈধ ও রুট পারমিটহীন বাস কর্তৃপক্ষের সামনে অবাধে চলাচল করছে। আবার ইজিবাইকসহ বিভিন্ন ধরনের অননুমোদিত যানবাহন ও যানবাহনের যন্ত্রাংশ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া উৎপাদন বা আমদানি করা নিষেধ থাকলেও সেটা করা হচ্ছে কোনো প্রকার কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে। এসবকে কেন্দ্র করে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয়েছে। তাই বলা যায়, অবৈধ অননুমোদিত যানবাহন ঠেকানোর উদ্যোগের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার পরিচয় মিলেছে।

মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন বাস-মিনিবাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা ও প্রাইভেট কারের মতো বিভিন্ন যানবাহনের সমস্যা আমাদের সড়কে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, দেশে চলাচলরত ৩৩ শতাংশ যাত্রীবাহী বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই। সে হিসেবে সারা দেশে ফিটনেস নবায়ন ছাড়াই সাড়ে পাঁচ লাখ যানবাহন সড়কে চলাচল করছে। এছাড়া ৫৬ শতাংশ বাসের গতি নিয়ন্ত্রক সার্টিফিকেটও নেই। তার সঙ্গে দেশে গত এক বছরে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। দফায় দফায় কর মওকুফের পরও মালিকরা গাড়ির ফিটনেস হালনাগাদ করছেন না। যে কারণে গত প্রায় এক বছরে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর অন্যান্য কারণের মধ্যে ছিল ৬৬ হাজার ৬৬১টি ফিটনেসবিহীন যানবাহন। তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, সরকারি সংস্থাই যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা ছাড়াই সনদ দিয়ে দিচ্ছে। অথচ বিআরটিএ প্রধান কার্যালয়ের পরিদর্শন ও পরীক্ষা ছাড়া কোনো গাড়ির ফিটনেস সনদ দেয়া হচ্ছে কিনা, তা তদারকির জন্য কমিটি রয়েছে। কিন্তু এ কমিটি নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে।

বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে কাঠামোগত ত্রুটিসহ নানান অসংগতির কারণে অবৈধ বা অননুমোদিত যানবাহনগুলোয় নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে, এটা বোঝা গেলেও মানুষের দৈনন্দিন যাতায়াত প্রয়োজন এবং বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবিকার স্বার্থের দিকে তাকিয়ে এসব যানবাহনকে রাস্তা থেকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা সম্ভব হবে না। তাই এসব যানবাহনকে কাঠামোগত একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানোন্নয়ন, সেগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং চালকদের প্রশিক্ষণ ও নিবন্ধিত করে এগুলোকে অনুমোদনের ব্যবস্থার আওতায় আনা প্রয়োজন। আর সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত হবে দ্রুততার সঙ্গে অবৈধ, রুট পারমিটহীন ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন সড়ক-মহাসড়কে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা এবং তার বিকল্প দ্রুততার সঙ্গে খুঁজে বের করা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন