কার্বন নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগে দ্বিগুণ হতে পারে শিপিং খরচ

বণিক বার্তা ডেস্ক

মিসরের সুয়েজ খালে পণ্যবাহী জাহাজ ছবি: রয়টার্স

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঠেকাতে সারা বিশ্বেই কার্বন নিঃসরণ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে। পরিবহন খাত বিবেচনায় নিলে সড়কে বিদ্যুচ্চালিত নতুন নতুন যানের উদ্ভাবন নিট-শূন্য কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রাকে অনেকটাই এগিয়ে দিচ্ছে। তবে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে রয়েছে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের অন্যতম মাধ্যম শিপিং শিল্প। এরই মধ্যে এ খাতে ভারসাম্য তৈরিতে ডিকার্বনাইজেশন প্রবিধানের উদ্যোগ নিয়েছে একাধিক পক্ষ। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এ খাতে যেকোনো ধরনের পরিবর্তনে জাহাজ মালিক ও অপারেটর কোম্পানিগুলো সামনের বছরগুলোয় অতিরিক্ত খরচের সম্মুখীন হবেন। এমনকি শিপিং খরচ দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। খবর দ্য স্ট্রেইটস টাইম।

জাহাজ শিল্পে বিকল্প জ্বালানির পরীক্ষা ও বাস্তবায়নের জন্য নতুন ধরনের প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোর বিকাশ প্রয়োজন, যা বাণিজ্যিক জাহাজ কোম্পানিগুলোর ঘাড়ে বড় ধরনের খরচ ঝুলিয়ে দিতে পারে। সেই খরচ পুষিয়ে নিতে বাড়তে পারে পণ্যের দাম।

নিট-শূন্য কার্বন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) সম্প্রতি ২০৫০ সাল মেয়াদি উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষক সংস্থা ডেট নর্স্ক ভেরিটাস এএসের (ডিএনভি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইএমওর লক্ষ্য পৌঁছানোর জন্য কার্বন অপসারণ ও পরিবেশের ওপর শিপিংয়ের প্রভাব কমাতে নতুন প্রযুক্তি ও জ্বালানি প্রয়োজন, যা সামগ্রিকভাবে শিপিং ও ভোক্তাদের জন্য ব্যয়বহুল হবে। এতে কন্টেইনারবাহী জাহাজের ভাড়া আগামী ২৫ বছরে দ্বিগুণ হতে পারে। আর বাড়তি অর্থের চাপ শেষ পর্যন্ত ক্রেতাদের ওপরই আসবে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শিপিং রুট যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ভবিষ্যতে তেমনই থাকবে বলে পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে। কিন্তু গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণে জাহাজ শিল্প অন্যতম ও ক্রমবর্ধমান উৎস। ইউরোপীয় কমিশনের মতে, ২০১৮ সালে মানুষের কারণে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের প্রায় ২ দশমিক ৯ শতাংশের জন্য দায়ী ছিল জাহাজ শিল্প। পণ্যের চাহিদা বাড়ায় শিপিংয়ের চাহিদাও প্রতি বছর বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমবর্ধমান উচ্চ তাপমাত্রা ও চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ায় প্রভাব ফেলছে এ শিল্প।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বৈশ্বিক পরিসরে সবচেয়ে বড় সমঝোতা হলো প্যারিস চুক্তি। ২০১৬ সালের এ চুক্তিকে মান্যতা দিয়েই সাধারণত জলবায়ু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, শিপিংয়ের কারণে যদি জলবায়ু পরিবর্তনের চলমান প্রভাব অব্যাহত থাকে, তবে এটি প্যারিস চুক্তির উদ্দেশ্যকে ক্ষুণ্ন করবে। কারণ প্রাক-শিল্প যুগ-পরবর্তী বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমিত করার পরিকল্পনা ব্যাহত হবে। 

জলপথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে এরই মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গত জানুয়ারিতে কার্যকর হওয়া এক নীতি অনুসারে, অঞ্চলটি জলসীমায় পাঁচ হাজার টনের বেশি ওজনের জাহাজকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের জন্য ইইউ ইমিশনস ট্রেডিং স্কিমের অধীনে অনুমোদন কিনতে হয়। মূলত সরবরাহ চেইনে যুক্ত কোম্পানি এ অর্থ দিয়ে থাকে। এছাড়া আগামী বছরে এতে আরো কিছু প্রবিধান প্রয়োগের কথা জানানো হয়েছে। 

প্রয়োগ হতে যাওয়া নিয়মগুলোর একটি হলো ফুয়েলইইউ মেরিটাইম রেগুলেশন। এর ভিত্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে চলাচলকারী জাহাজে ব্যবহৃত জ্বালানি সাপেক্ষে বার্ষিক গড় গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের তীব্রতা নির্ধারণ করা হবে। এ নীতি অনুসারে, আগামী বছর থেকে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ ২০২০ সালের স্তর থেকে ২ শতাংশ কমাতে হবে। ২০৫০ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশ হ্রাসে পৌঁছানোর জন্য এ নিয়ম পরের বছরগুলোয় ক্রমান্বয়ে কঠোর হবে।৷

২০৫০ সালের মধ্যে সামুদ্রিক খাতকে নিট-শূন্য নিঃসরণ অর্জনে সহায়তা করার জন্য উন্নত জৈব জ্বালানি ও হাইড্রোজেনের মতো ক্লিনার ফুয়েল গ্রহণে প্রবিধানটি ‘কার্যকরভাবে জোর দেয়’ বলে জানাচ্ছে ইইউ।

এরই মধ্যে সামুদ্রিক জ্বালানি থেকে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের তীব্রতা ও এর মূল্যনির্ধারণে কাজ করছে আইএমও। সামনের বছরগুলোয় এ বিষয়ে নীতি প্রয়োগ হতে পারে।

ডিএনভি বলছে, এ লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য সময় ও মূলধনের প্রয়োজন হবে। শিপিংকে ডিকার্বনাইজ করতে প্রথমে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস, তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস, অ্যামোনিয়া ও মিথানলের মতো কার্বন নিরপেক্ষ জ্বালানিতে রূপান্তর প্রয়োজন হবে। কারণ এসব জ্বালানি বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিট পরিমাণ বৃদ্ধি করে না। এর জন্য জাহাজের মালিকদের বিকল্প জ্বালানিকে প্রাধান্য দিয়ে এখনই নতুন ধরনের জাহাজ নির্মাণে বিনিয়োগ করতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বর্তমানে চালু থাকা জাহাজের ৯২ দশমিক ৬ শতাংশ শুধু জ্বালানি তেল ব্যবহার করে চলতে সক্ষম। তবে ক্রয়াদেশে থাকা জাহাজগুলোর অর্ধেক বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারে সক্ষম হবে।

বর্তমান সামুদ্রিক বাণিজ্যের অবস্থা যদি অপরিবর্তিত থাকে ডিএনভির পূর্বাভাস অনুসারে, আইএমওর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলে কনটেইনারযুক্ত পণ্য পরিবহনের খরচ ৯১ থেকে ১১২ শতাংশ বা অনুরূপ কনটেইনার পাঠানোর ক্ষেত্রে বর্তমানের তুলনায় খরচের প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে। ডিকার্বনাইজিং শিপিং ব্যয়বহুল হওয়ায় খরচের দায় শেষ পর্যন্ত গ্রাহকের ওপর বর্তাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন