জনবিমুখ অর্থনৈতিক পদক্ষেপের কী হবে?

ইমামূল হাছান আদনান ও মেহেদী হাসান রাহাত

ছবি : বণিক বার্তা

বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৮৮ শতাংশ। ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশের কাছাকাছি। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৩ বছরে সর্বোচ্চ। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আনুপাতিক হারে বরাদ্দ কমেছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয়ের বড় অংশই যায় পেনশনে। আবার সামাজিক নিরাপত্তাভোগীদের বড় অংশই ভুয়া ও অস্তিত্ববিহীন। সড়ক ও রেলসহ বড় বড় অবকাঠামো খাতে যে ব্যয় হয়েছে, তা-ও কিলোমিটারপ্রতি ব্যয়ে বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ। ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারের ঋণ বেড়েছে ১৫ লাখ কোটি টাকার বেশি। ফলে বাজেটের বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে ঋণের দায় পরিশোধে। এভাবেই চলেছে সরকারের বড় আকারের বাজেট, যার একটি বড় অংশই চুরি ও দুর্নীতির মাধ্যমে চলে গেছে সমাজের একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর কাছে। 

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে। দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছেন। তবে এখনো ২০২৪-২৫ অর্থবছরের কর, শুল্ক ও ব্যয় কাঠামো একই আছে। এখনো আছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার জনবিমুখ এ বাজেটের সংস্কার ও পরিবর্তন করবে বলে অপেক্ষায় সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে চলতি অর্থবছরের বাকি মেয়াদের জন্য একটি জনমুখী বাজেট ঘোষণারও সুযোগ রয়েছে। এ বাজেটে কী কী জনমুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়, তার অপেক্ষায় মানুষ। নতুন পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি কমবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সরকারের ব্যয় বাড়বে। জনগণের ওপর পরোক্ষ করের বোঝা কমবে। বিদ্যুৎ-পানিসহ যাতায়াত ব্যবস্থা আরো সাশ্রয়ী হবে—এমন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

গত দেড় দশকে ঘোষিত বাজেটে ঋণনির্ভরতা দেখা গেছে বেশি। যদিও কোনো অর্থবছরেই বাজেটের পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, আওয়ামী লীগের ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাজেট বাস্তবায়নের গড় হার ছিল ৮৬ শতাংশ। অর্থাৎ, অর্থবছরের শুরুতে যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল, বছর শেষে এর ১৪-১৫ শতাংশ অবাস্তবায়িত থেকে গেছে। পরে এ অবাস্তবায়িত বাজেটের অংশ আরো বড় হয়েছে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও ঘোষিত বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বাস্তবায়ন অযোগ্য। সংশোধিত বাজেটে বাদ দিতে হবে, এমন অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। ঘোষিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি আদায় হবে না। আবার ঘাটতি বাজেট সংস্থানে যেসব উৎসের কথা বলা হয়েছে, সেখান থেকেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ঋণ মিলবে না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) কাটছাঁট করার পাশাপাশি অপব্যয় ও দুর্নীতি বন্ধ হলে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ৫ থেকে সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকায় নেমে আসবে। এ অবস্থায় অগুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প বাদ দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষার মতো খাতগুলোয় বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। 

কয়েক বছর ধরেই মন্দাক্রান্ত সময় পার করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা মানুষ । ডলার সংকট, রিজার্ভের বড় ক্ষয়সহ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিপদে ছিল বাংলাদেশ। এর পরও প্রতিবারেই ঘোষিত বাজেটের আকার আগের বারের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।

চলতি অর্থবছরে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। আর ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে ঘাটতি বাজেট। এ ঘাটতি মেটানোর কথা ব্যাংকসহ দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে। বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে এডিপি হিসাবে। বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও অর্থবছরের প্রথম মাস তথা জুলাইয়েই মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় দ্বিগুণে।

ঘোষিত বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্য সরবরাহের ওপর উৎসে কর ২ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়া হয়। এ ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার স্থিতিশীল করা। যদিও কর ও শুল্কছাড়ের ঘোষণায় পণ্যের দাম কমেনি। উল্টো অর্থবছরের প্রথম মাসে প্রতিটি পণ্যের দাম আরো উসকে ওঠে। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ঠেকে, যা দেড় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। জুলাইজুড়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সংঘাত-সংঘর্ষের জের ও সরকারের নেয়া পদক্ষেপে অর্থনীতিতেও ছিল নজিরবিহীন স্থবিরতা। 

সাবেক অর্থ সচিব এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী মনে করেন, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ খাতের যেসব প্রকল্প রয়েছে, সেগুলোয় সুশাসন কাঠামো দুর্বল। তাই ভৌত অবকাঠামো খাতে নতুন করে অর্থ ব্যয় অনেকাংশে কমিয়ে আনতে হবে। এর পরিবর্তে অবকাঠামো মেরামতের কোনো বিষয় থাকলে সেখানে গুরুত্ব দিতে হবে। ভৌত অবকাঠামো খাত থেকে উপযোজন করে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন সুবিধা, শিক্ষার গুণগত মান ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বরাদ্দ বাড়ানো যেতে পারে। মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে এবং তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। তাই সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানো উচিত। প্রত্যক্ষভাবে মানুষ উপকৃত হবে এমন খাতেই অর্থ ব্যয় করা দরকার।

প্রতি বছরই বড় অংকের ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করায় সরকারের ঋণের বোঝা কেবলই স্ফীত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত জুন শেষে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল অন্তত ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন সরকারের ঋণ স্থিতি মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা ছিল। সে হিসাবে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলেই সরকারের ঋণ স্থিতি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বেড়েছে, যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ। 

ঘোষিত বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় মেটানো ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে এ ঋণ নিয়েছে সরকার। যদিও সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির বেশুমার অভিযোগ রয়েছে। এ সময়ে অবাধ লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। জনগণের লুণ্ঠিত এসব অর্থ পাচার হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী)। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও কম।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঘাটতি বাজেট পূরণে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যদিও এ পরিমাণ ঋণ দেয়ার সক্ষমতা দেশের ব্যাংক খাতের নেই। অনিয়ম-দুর্নীতি আর লুণ্ঠনের শিকার দেশের ব্যাংক খাত তিন বছর ধরেই তারল্য সংকটে ভুগছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৮-২২ সাল—পাঁচ বছরেই ব্যাংকসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ বাড়ে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষেও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের মোট ঋণ ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে তা ৭ লাখ ১৭ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

ব্যাংক খাতে সরকারকে ঋণ দিতে ব্যর্থ হলে গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়। এতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে জনগণের কাছ থেকে এ ঋণ নিয়েছে সরকার। সরকারের ঋণের চাহিদা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় এর সুদহারও দ্বিগুণ-তিন গুণ বেড়ে গেছে। ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার এখন ১২-১৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। যদিও দুই বছর আগে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার ছিল ১ থেকে ৬ শতাংশ।

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলে গত দেড় দশকে বিদেশী উৎস থেকেও অস্বাভাবিক হারে ঋণ নিয়েছে সরকার। ২০১০ সালেও বিদেশী উৎস থেকে নেয়া সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল মাত্র ২০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ ঋণের স্থিতি ৫৯ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪ সালের মার্চ শেষে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী ঋণের স্থিতি ৭৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী (প্রতি ডলার ১১৮ টাকা হারে) বাংলাদেশী মুদ্রায় সরকারের ঋণের স্থিতি ৯ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ঋণ স্থিতি বেড়ে যাওয়ায় সুদ খাতে সরকারের ব্যয়ও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে কেবল সুদ পরিশোধ বাবদ সরকারের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা।

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাজেটের পুরোটাই পর্যালোচনা করা দরকার বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বাজেটের তিনটি অংশ আছে—রাজস্ব আহরণ, সরকারি ব্যয় এবং বাজেট ঘাটতি ও তার অর্থায়ন। সবকিছু একসঙ্গে ঠিক করা যাবে না। এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে যে কোন জায়গা থেকে শুরু করতে হবে। আমার মনে হয় প্রথমে হাত দিতে হবে ব্যয়ের দিকে। কারণ সরকার বর্তমানে আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যে আছে। প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা আমরা অর্থায়ন করতে পারব কিনা সেটির একটি মূল্যায়ন দরকার। এক্ষেত্রে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্য দেয়া আছে সেটি কতটুকু অর্জনযোগ্য তার একটি বাস্তবভিত্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘স্থানীয় সরকার, জ্বালানি, পরিবহন খাতসহ অন্যান্য খাতে নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন অনেক প্রকল্প রয়েছে যেগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যক্তি স্বার্থে, দলীয় স্বার্থে ও গোষ্ঠী স্বার্থে করা হয়েছে। এ ধরনের প্রকল্পগুলোকে বাদ দিতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে কাটছাঁটের সুযোগ আছে, সেখানে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে।’

উন্নয়ন প্রকল্পসহ পরিচালন খাতে সরকারের অপব্যয় ও দুর্নীতির বোঝা জনগণের ওপর পড়ছে। জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়ছে। আবার সেসব পণ্যের ওপর শুল্কও বেশি হারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। ধনীদের কাছ থেকে কর আহরণে ব্যর্থতার কারণে মূল্য সংযোজন করের (মূসক) ওপর সরকারকে বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়ছে। অন্যদিকে কর ফাঁকি দেয়া কালো টাকার মালিকদের প্রায় প্রতি বছরই অর্থ বৈধ করার নামে অন্যায্য সুবিধা দেয়া হয়, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটেও বহাল রয়েছে। এছাড়া অনিয়ম ও কারসাজির কারণে ধুঁকতে থাকা পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মূলধনি মুনাফার ওপরও চলতি অর্থবছরের বাজেটে করারোপ করা হয়েছে। যদিও এর মাধ্যমে কী পরিমাণ কর আহরণ হতে পারে সে বিষয়ে বাজেটে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৮৮ শতাংশ। গত দেড় দশকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ১৪ বার। এ সময় বিদ্যুতের সব শ্রেণীর গ্রাহকের দাম বেড়েছে দফায় দফায়। গত বছরের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৫ শতাংশ হারে মোট ১৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়েছে আরো ৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ খাতকে পর্যায়ক্রমে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলা হয়। এরই অংশ হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর বিদ্যুতের দাম চারবার বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।

বিদ্যুতের মতোই দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কমানোর ঘোষণার মধ্যেও গত ফেব্রুয়ারিতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় আরেক দফায়। গত বছরের জানুয়ারিতেও ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল।

বিদেশ থেকে জ্বালানি তেল এনে জনগণের কাছে বিক্রি করে সরকার। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য বলছে, গত এক দশকে তেল বিক্রি বাবদ প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা হয়েছে ৪৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ অর্থ বিপিসির কাছে থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি তেল বিক্রিতে প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা করেই চলেছে। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিপিসির মুনাফার পরিবর্তে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল বিক্রিতে বেশি মনোযোগী হওয়ার কথা।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় ঢাকাবাসীকে প্রতি হাজার লিটার পানির জন্য গুনতে হতো ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। ২০২৪ সালে এসে প্রতি হাজার লিটার পানির জন্য ঢাকা ওয়াসাকে ১৬ টাকা ৭০ পয়সা পরিশোধ করতে হচ্ছে। গত ১৬ বছরে পানির মূল্য ৫ থেকে প্রায় ১৭ টাকায় এসে ঠেকার বিষয়টি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও ওয়াসার সীমাহীন দুর্নীতির ফল বলে মনে করা হয়।

শুধু বিদ্যুৎ, জ্বালানি কিংবা ঢাকা ওয়াসাই নয়, বরং এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংক খাতেও নজিরবিহীন অস্থিরতা চলছে। গত কয়েক বছরে পুনঃতফসিল, অবলোপনসহ বিভিন্ন নীতিমালার উদারীকরণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। আবার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ‘মালিকানায়’ থাকা ব্যাংকগুলোকে অবাধে অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ দেয়া হয়েছে। ওই ব্যাংকগুলোয় যথাযথভাবে নিরীক্ষাও করা হয়নি। ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের ব্যাংক খাত থেকে নেয়া বেনামি ঋণ, পুনঃতফসিলকৃত ও অবলোপনকৃত ঋণসহ আদায় হবে না এমন ঋণের পরিমাণ অন্তত ৭ লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে বের হয়ে যাওয়া এ ঋণের বড় অংশই দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। অথচ ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। 

বিরাজমান অস্থির সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে বাস্তবধর্মী ও কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যাংক খাত ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। বাজেটের আকার, বাস্তবায়ন ও দক্ষতার বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে বাস্তবায়ন করা কেন সম্ভব হচ্ছে না সেটি নিয়ে কিন্তু কখনো তদন্ত করা হয়নি। আর্থিক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয় এগুলোয় পদ্ধতিগতভাবে হাত দিতে হবে। এক্ষেত্রে যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্বকে দায়িত্ব দিতে হবে। আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কোন কোন বিষয়ে তারা সংস্কার করতে চান সেটি সুনির্দিষ্ট করে ঘোষণা দিতে হবে। ঘোষণা দেয়ার পর সংস্কারকাজ শুরু করে দিতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন