পেশায় চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রিমি রহমানের বাসায় সদ্য গৃহকর্মীর কাজ নিয়েছেন কাকলী। দেখেশুনে বেশ ভালো ও অভিজ্ঞ মনে হওয়ায় তাকে ঘরের কাজে নিয়োগ দেন রিমি। কিন্তু কয়েক দিন পর খেয়াল করেন কাকলীর পায়ের পাতায় ও আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে সংক্রমণ রয়েছে। তিনি দেখেই বুঝতে পারেন এটি একধরনের চর্মরোগ, যার নাম টিনিয়া পেডিস। এটি ছত্রাকজনিত ছোঁয়াচে একটি রোগ। ঘরে শিশুরা থাকায় রিমি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি কাকলীকে কিছু ওষুধ লিখে দেন এবং সুস্থ হলে আবার কাজে যোগ দিতে বলেন।
ছত্রাকজনিত চর্মরোগ
সাধারণত দেহের নানা ভাঁজে ফাঙ্গাস বা ছত্রাক জন্মায়। মুখ, গলা, পায়ের আঙুল, মলদ্বার, কুঁচকি, পিঠ, বুক ও মাথার ত্বকে ছত্রাকজনিত সংক্রমণ বেশি হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে তীব্র চুলকানির পাশাপাশি কখনো কখনো দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত তৈরি হয়ে যায়। এটি শিশু থেকে বৃদ্ধ যেকোনো বয়সী মানুষের শরীরের বিভিন্ন স্থানে হতে পারে। সাধারণত গ্রীষ্মকালে ও বর্ষাকালে ছত্রাকজনিত এসব রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়।
আমাদের দেশের আবহাওয়া, প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও ভিটামিনের ঘাটতি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকা, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, সঠিক পোশাক ব্যবহার না করা, ওষুধের ডোজ সম্পন্ন না করা, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই নানা ওষুধ সেবন করাসহ নানা কারণে ছত্রাকজনিত চর্মরোগ ও এর প্রদাহ বেড়ে চলেছে।
ছত্রাকজনিত চর্মরোগের নানা ধরন
ত্বকে যেকোনো ধরনের ছত্রাকের সংক্রমণকে বলা হয় টিনিয়া বা দাদ। দাদের রয়েছে নানা ধরন। শরীরের স্থানভেদে এর নাম, উপসর্গ ও চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন পায়ের পাতায় সংক্রমণ হলে তাকে বলে টিনিয়া পেডিস বা অ্যাথলিট ফুট। পিঠ, বুক, পেট ও হাত-পায়ে সংক্রমণ হলে তাকে বলা হয় টিনিয়া কর্পোরিস বা রিংওয়ার্ম। ছত্রাকজনিত চর্মরোগের ক্ষেত্রে টিনিয়ার এ ধরন সবচেয়ে বেশি হতে দেখা যায়। এছাড়া কুঁচকির দাদকে বলা হয় টিনিয়া ক্রুরিস। নখের দাদকে বলা হয় টিনিয়া আঙ্গুয়াম। মাথার ত্বকে দাদ হলে বলা হয় টিনিয়া ক্যাপাইটিস।
উপসর্গ
• দাদ হলে প্রচণ্ড চুলকানি হয়।
• চুলকালে কষ বের হয়।
• আক্রান্ত স্থানের চামড়ার ওপর গোলাকার/চাকার মতো ক্ষত তৈরি হয়।
• ধীরে ধীরে চাকার পরিধি বাড়তে থাকে।
• ক্ষতস্থানের চামড়া খুশকির মতো সাদা হয়ে যায়।
• আক্রান্ত অংশে পানি বা পুঁজভর্তি দানা দেখা দেয়।
• নখে হলে নখ ভঙ্গুর ও অস্বচ্ছ হয়ে যায়।
• কুঁচকি বা কোমরে হলে চামড়া সাদা ও পুরু হয়ে যায়।
যেসব কারণে সংক্রমণ হয়
• ত্বক দীর্ঘ সময় ভেজা অবস্থায় থাকলে।
• বারবার একই মোজা ব্যবহার করলে।
• আঁটসাঁট জুতা পরার কারণে পা ঘেমে থাকলে।
• জুতা ছাড়া খালি পায়ে হাঁটলে।
• আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে স্থানে অবস্থান করলে।
• ব্যবহৃত জামা-কাপড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না রাখলে।
• ঘামে ভেজা কাপড় না ধুয়ে পুনরায় ব্যবহার করলে।
• সংক্রমিত ব্যক্তির তোয়ালে, বিছানা ও কাপড় ব্যবহার করলে।
• ঘরে রোগাক্রান্ত বিড়াল বা অন্যান্য প্রাণী থাকলে।
চিকিৎসা
ছত্রাকজনিত চর্মরোগ আমাদের সমাজে অত্যন্ত পরিচিত একটি সমস্যা। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি বছর আমাদের দেশে অন্তত ৮০-৯০ হাজার মানুষ ছত্রাকজনিত চর্মরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। চিকিৎসার মাধ্যমে খুব কম সময়ের মধ্যেই এ রোগ ভালো হয়ে যায়। তবে কিছুদিন পর আবার দেখা দেয়। এর অন্যতম কারণ, কিছুটা সুস্থ হলেই রোগীরা ওষুধ সেবন করা বন্ধ করে দেয়। কখনো কখনো ওষুধের ডোজ সম্পন্ন করলেও এ রোগ ফিরে আসতে দেখা যায়।
কারণ ওষুধ সেবন করলেও রোগী আগের ব্যবহৃত কাপড়চোপড় ভালোভাবে পরিষ্কার না করে আবার ব্যবহার করে। ফলে খুব সহজেই কাপড় থেকে ছত্রাক পুনরায় দেহে প্রবেশ করে। ছত্রাক সংক্রমণ মারাত্মক কিছু নয়, তবে কখনো কখনো এর নিরাময় কঠিন হয়ে উঠতে পারে। রোগীর ডায়াবেটিস থাকলে বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম হলে দ্রুত চিকিৎসা নেয়া জরুরি। দেরি হলে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে।
প্রতিরোধ ও সচেতনতা
• ছত্রাকজনিত এ চর্মরোগ অত্যন্ত ছোঁয়াচে। তাই দ্রুত এর চিকিৎসা নিতে হবে।
• দৈনন্দিন জীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
• সংক্রমিত স্থান বারবার ধুয়ে পরিষ্কার ও শুকনো রাখতে হবে।
• অন্যের জিনিস ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
• আক্রান্ত স্থান স্পর্শ করলে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
• খালি পায়ে হাঁটা থেকে বিরত থাকতে হবে।
• ঘেমে গেলে দ্রুত পোশাক পরিবর্তন করতে হবে।
• প্রতিদিন গোসল করতে হবে।
• রাস্তার নোংরা পানি গায়ে বা পায়ে লাগলে দ্রুত ধুয়ে ফেলতে হবে।
• ত্বকের ভাঁজগুলো সব সময় শুকনো রাখার চেষ্টা করতে হবে।
• সহজে বাতাস চলাচল করতে পারে এমন জুতা পরতে হবে।
লেখক: চর্ম, অ্যালার্জি, যৌন রোগ, কসমেটিক ও লেজার বিশেষজ্ঞ ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিকস