বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি

পোশাক খাতে দক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা পূরণ করতে পেরেছি

ছবি : বণিক বার্তা

শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউএফটি) বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান। বিশ্ববিদ্যালয়টির সাফল্য, অর্জন তৈরি পোশাক খাতের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম

বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরুর গল্প জানতে চাই।

তৈরি পোশাক খাতের একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আমাদের পূর্বসূরীরা শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন পলিসি নিয়ে কাজ করেছেন। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন রকমের টেকনোলজির ট্রেনিং দিতে কোরিয়ায় পাঠিয়েছেন। তারা শিল্পটিকে আধুনিক, উন্নত সফল করার জন্য এলসি সিস্টেম চালু করেন, যেখানে মাস্টার এলসিকে লিয়েন রেখে কাঁচামাল আমদানির সুবিধা চালু হয়। নব্বইয়ের দশকে দেশে কার্টুন বক্স, বোতাম থেকে শুরু করে পলিথিনও আমদানি করে রফতানি করতে হতো। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ শিল্পায়নের উন্নতির দিকে যেতে থাকে। যদিও আমাদের কাঁচামাল নেই, তার পরেও আমরা শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার জন্য শিল্প স্থাপন করি।

আমাদের দেয়া সব সুপারিশের অধিকাংশই সরকার গ্রহণ করেন। শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকার নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। তখন ওই সময়টায় বাংলাদেশে দক্ষ মানবসম্পদের একটা বিশেষ অভাব আমরা লক্ষ করি। দেশে অনেক কোরিয়ান, শ্রীলংকান, ইন্ডিয়ান পাকিস্তানিরা কাজ করত। ট্রেনিংয়ের ফলে লোকজন শিক্ষিত হতে শুরু করল, কিন্তু প্রয়োজন দেখা দিল আনুষ্ঠানিক শিক্ষার, শিক্ষিত মানবসম্পদের। আমরা সিদ্ধান্ত নিই দেশে টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাকগ্রাউন্ড যাতে টেক্সটাইল এবং এর সঙ্গে রিলেটেড অন্যান্য যেমন কম্পিউটার সায়েন্স, ব্যবসায় প্রশাসন, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইংরেজি ইত্যাদির মতো বিষয়ে দক্ষতাসম্পন্ন হয়, এমন পরিকল্পনা করি।

প্রথম ১৯৯৯ সালের দিকে তৎকালীন বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট জনাব আনিসুর রহমান সিনহার উদ্যোগে একটি ইনস্টিটিউট করার সিদ্ধান্ত নিই। এরপর বিজিএমইএ ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির বোর্ড অব গভর্ন্যান্সের দায়িত্ব নিয়ে কাজটা এগিয়ে নেন জনাব হারুন-অর-রশিদ। পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব পালন করেন জনাব সিরাজুল হক জনাব বেনজীর আহমেদ। সর্বশেষ সিমকো হোল্ডিংস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোজাফ্ফর ইউ সিদ্দিক বোর্ডের দায়িত্বে থাকাকালে ২০১২ সালে ইনস্টিটিউট থেকে পরিবর্তন হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হয়। আমাদের উদ্যোক্তারা তাদের মূল্যবান সময় দিয়ে ইনস্টিটিউট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দিয়েছেন। তখন থেকেই পথচলা। আমাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে তৈরি পোশাক বস্ত্র শিল্পে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি। খাতে যদি আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ না থাকে, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব হবে না। লক্ষ্য অর্জনে আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ প্রয়োজন। উদ্দেশ্যেই আমরা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করি।

যে স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক যুগে কতটুকু অর্জন হলো?

আমাদের ইউনিভার্সিটি সবার থেকে ব্যতিক্রম। ইউনিভার্সিটি যারা প্রতিষ্ঠা করেছেন তারা প্রত্যেকেই একজন সফল উদ্যোক্তা। একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পাওয়ার দিকে থেকে ইউনিভার্সিটি ব্যতিক্রম। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষার্থীরা চাকরি পাচ্ছেন। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে আমাদের এখানে প্রায় ২৭টি কোর্স হচ্ছে। বিদেশের শিক্ষার্থীরা আমাদের এখানে আসছেন, আমাদের এখানকার শিক্ষার্থীরাও বাইরের দেশে যাচ্ছেন, প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। গত মাসেও জার্মানি থেকে একদল শিক্ষার্থী আমাদের এখানে এসেছে। আমরা এরই মধ্যে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সোর্সিং দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছি। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী নিজেরা উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শুধু বাংলাদেশেই তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছেন তা নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তারা  ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তারা জাতীয় পুরস্কার পাচ্ছেন। অর্জন আসলে আমাদের সার্বিক চেষ্টার ফসল। পোশাক খাতে দক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা পূরণের চেষ্টা আমরা অব্যাহত রেখেছি।

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, শিক্ষা ব্যবস্থার বড় সংকট একাডেমির সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির সমন্বয় নেই। একজন শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।

একাডেমিক শিক্ষা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সমন্বয় খুবই জরুরি। বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা আমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকেই প্র্যাকটিক্যাল নলেজ পাচ্ছেন। আর এটা তখনই সফল পরিণতিতে যেতে পাববে যখন ইন্ডাস্ট্রিতে কী হচ্ছে তা ভালোভাবে জানবে। একাডেমি ইন্ডাস্ট্রির কোলাবরেশনের যে ঘাটতি এটা একাডেমিক কারিকুলাম পরিবর্তন বা শিল্প উদ্যোক্তা যারা রয়েছেন তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কারিকুলাম গঠন করা দরকার। বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটির সঙ্গে লোকাল রিটেইলারদের কোলাবরেশন রয়েছে। আন্তর্জাতিক যেসব ব্র্যান্ড আছে তাদের সঙ্গেও আছে। যেমন এইচএনএম, জারা, ওয়ালমার্ট। তারা চাহিদা দেন যে আমাদের এখানে এতজন গ্র্যাজুয়েট লাগবে। আমরা নিবিড়ভাবে যাচাই করে কাজগুলো করার চেষ্টা করি। কারণেই আমি বলি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিক্রম।

আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একজন উদ্যোক্তা হিসেবে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

আমরা আমাদের লক্ষ্যগুলো অর্জন করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছি। আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা হচ্ছে। মাঝে মাঝে এখানে ফ্যাশন শো হয়। তাদের তৈরি নতুন প্রডাক্টের ডিসপ্লে হচ্ছে। এভাবেই ভালো কিছু অর্জন করা সম্ভব। চায়না, ভারত ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমাদের কোলাবরেশন বেশি। সেখানে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত যাচ্ছে। এছাড়াও বিদেশের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমাদের এমওইউ রয়েছে। যার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীরা করেস্পোন্ডিং কোর্স করার সুযোগ পাচ্ছে এবং তারাও আমাদের এখানে হাতে কলমে শিক্ষাগ্রহণ করছে। পাশাপাশি শিক্ষকরাও আসছেন এবং আমাদের এখানকার শিক্ষকরাও যাচ্ছেন।

মেধাবী অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য কী কী সুযোগ-সুবিধা রয়েছে?

ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা শতাংশ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পড়াশোনা করাই। এর বাইরে আমাদের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা মিলে একটা ফান্ড করেছি। এরই মধ্যে স্বনামধন্য হামীম গ্রুপসহ বেশ করেকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান এই ফান্ডে যুক্ত থেকে মেধাবী অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ দিচ্ছেন। 

বাংলাদেশ থেকে ইইউর পোশাক আমদানি প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ ১০টি তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশের মধ্যে বাংলাদেশের রফতানি সবচেয়ে বেশি কমেছে। কর্মসংস্থানে এর কেমন প্রভাব পড়বে?

বর্তমানে পৃথিবীতে অনাকাঙ্ক্ষিত দুটি ঘটনা হলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যু। করোনা শেষ হওয়ার পর যুদ্ধের প্রভাব দেখছে বিশ্ব। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের কারণে লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজ যেতে পারছে না। হুথি বিদ্রোহীরা আক্রমণ করছে। আমেরিকাসহ যেসব উন্নত রাষ্ট্রে আমরা পণ্য রফতানি করি সবাই একটা মূল্যস্ফীতি প্রেশারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাদের আমদানি কমেছে। আর যখন আমাদের রফতানি কমে যায় তখন এর প্রভাব কর্মসংস্থানের ওপর পড়াটাই স্বাভাবিক। যদি রফতানি কমে যায় তাহলে অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তাই অর্ডারও তখন কম হবে। অর্ডার যখন কমে যাবে তখন স্বাভাবিকভাবেই কর্মী ছাঁটাই করা হবে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই বর্তমান বিশ্বের বৈশ্বিক পরিস্থিতি দ্রুতই স্বাভাবিক হবে।

এক যুগ পর বিশ্ববিদ্যালয়কে কোথায় দেখতে চান?

বিশ্ববিদ্যালয়ে এরই মধ্যে আমরা ফ্যাশন ডিজাইন, মার্চেন্ডাইজিং, ব্যবসায় প্রশাসন, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং, নিটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংসহ আরো যত টেকনিক্যাল সাবজেক্ট আছে এগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি শেখাচ্ছি। কম্পিউটার সায়েন্সের ওপরও জোর দিচ্ছি। আমরা বর্তমানে থাকা পাঁচ-ছয় হাজার শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরো বাড়াতে চাই। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে চাই। আমরা উন্নত মানের মানবসম্পদ তৈরি করার ক্ষেত্রে আরো বেশি সাবজেক্ট, আরো গবেষণার দিকে জোর দিচ্ছি। আশা করছি এক যুগ পর এটি বাংলাদেশের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি পাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন