বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস রিজার্ভের সঙ্গে নিটের ব্যবধান এখন ৫০ শতাংশ

হাছান আদনান

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভের সঙ্গে নিট রিজার্ভের ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল শেষে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ ছিল ১২ দশমিক বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ওইদিন গ্রস রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার ছিল। সে হিসাবে গ্রসের সঙ্গে নিট রিজার্ভের ব্যবধান ছিল ১২ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার বা ৫০ দশমিক ৪৫ শতাংশ

আইএমএফের শর্ত আমলে নিয়ে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যালেন্স অফ পেমেন্টস এন্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল ( যা বিপিএম- নামে পরিচিত) অনুসরণ করে রিজার্ভের পৃথক তথ্য প্রকাশ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৩০ এপ্রিল বিপিএম৬ অনুযায়ী, দেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। তবে বিপিএম- রিজার্ভ হিসেবে পুরোটা ব্যবহারযোগ্য নয়। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ বলতে আইএমএফ নিট রিজার্ভ কত আছে সেটাকে বোঝায়। ওইদিন নিট রিজার্ভ ১২ দশমিক বিলিয়ন ধরলে এক্ষেত্রেও ব্যবধান দশমিক ১৫ বিলিয়নে দাঁড়ায় অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের হিসাবেও রিজার্ভের সঙ্গে নিট রিজার্ভের ব্যবধান প্রায় ৩৬ শতাংশ

বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা নিচ্ছে সরকার। সংস্থাটির পক্ষ থেকে গত সোমবার ঋণের তৃতীয় কিস্তি বাবদ ১১৫ কোটি ডলার ছাড়ের অনুমোদন দেয়া হয়। ওইদিনই বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইএমএফ। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০২২ সালের জুনে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ ছিল ২৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে দেশের দশমিক মাসের আমদানি চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল। এরপর থেকে নিট রিজার্ভ কমে আসায় আমদানি চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা দুর্বল হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে তথা জুন শেষে নিট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে। রিজার্ভ দিয়ে মাত্র দশমিক মাসের আমদানি দায় মেটাতে পারবে বাংলাদেশ। কোনো দেশের রিজার্ভ দিয়ে সর্বনিম্ন তিন মাসের আমদানি দায় মেটানোর সক্ষমতা থাকলে সেটিকে ঝুঁকিমুক্ত মনে করা হয়

আইএমএফের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার সংশোধনে সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় অন্যান্য সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতিতেই ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইএমএফ।

ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশকে ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হতো। ওই সময় নিট রিজার্ভ ১৬ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার সংরক্ষণে সমর্থ হয় বাংলাদেশ। তবে এরপর নিট রিজার্ভ আরো কমেছে। অবস্থায় রিজার্ভ সংরক্ষণের শর্ত শিথিল করে আইএমএফ বলেছে, চলতি জুনের মধ্যে ১৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হবে। যদিও বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, পুনর্নির্ধারিত শর্ত পালনেও ব্যর্থ হতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক

অর্থনীতিবিদ . আহসান এইচ মনসুর বলছেন, আইএমএফের সঙ্গে দেশের ঋণ যত বাড়বে, নিট রিজার্ভের পরিমাণও তত কমবে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, নিট রিজার্ভ হিসাবায়নের ক্ষেত্রে আইএমএফ কোনো দেশের দায়কে বাদ দিয়ে হিসাব করে। আইএমএফ থেকে এখন আমরা ঋণ নিচ্ছি। সংস্থাটির কাছ থেকে নেয়া ঋণ যুক্ত হলে বাংলাদেশের গ্রস রিজার্ভ বাড়বে। কিন্তু নিট রিজার্ভ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সেটির কোনো ভূমিকা থাকবে না।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, নিট রিজার্ভ বাড়াতে হলে দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ইতিবাচক ধারায় আসতে হবে। দেশে বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহ প্রত্যাশার ধারেকাছেও নেই। সরকার নিজেও বিদেশী উৎস থেকে ঋণ না নিয়ে দেশের ব্যাংক খাতনির্ভর হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বাড়লেও রফতানি আয় দেশে আসছে না। পরিস্থিতি চলতে থাকলে রিজার্ভের উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ছিল ২০২১ সালের আগস্টে। এর পর থেকেই রিজার্ভে ধারাবাহিক ক্ষয় চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী, গত ১৯ জুন দেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার দেখানো হয়েছে। রিজার্ভের অস্বাভাবিক ক্ষয়ের জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে দায়ী করে আসছে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক।

যদিও আইএমএফের তথ্য বলছে, প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ সমসাময়িক অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রিজার্ভই সবচেয়ে বেশি কমেছে। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রায় ৪৫ শতাংশ কমেছে। সময়ে থাইল্যান্ডের রিজার্ভ কমেছে শতাংশ। আর ফিলিপাইনের কমেছে শতাংশের মতো। রিজার্ভ অপরিবর্তিত ছিল ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ আফ্রিকার। গত দুই বছরে প্রতিবেশী ভারতের শতাংশ মেক্সিকোর রিজার্ভ প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। সময়ে রিজার্ভ বেড়েছে ব্রাজিল মালয়েশিয়ারও।

রিজার্ভের ক্ষয় থামাতে গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন ঘটানো হয়েছে। প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৪ থেকে বেড়ে এখন আনুষ্ঠানিক মাধ্যমেও ১১৮ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। সে হিসাবে সময়ে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। আইএমএফের তথ্য বলছে, সমসাময়িক অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে গত দুই বছরে বাংলাদেশের মুদ্রারই সবচেয়ে বেশি অবমূল্যায়ন ঘটেছে। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে ভারতের রুপির অবমূল্যায়ন হয়েছে ১০ শতাংশের মতো। সময়ে মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, ইন্দোনেশিয়ান রুপি, থাইল্যান্ডের বাথ, ব্রাজিলিয়ান রিয়েল, ফিলিপাইনি পেসোর প্রায় ১২ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটেছে। আর ডলারের বিপরীতে ১৫ শতাংশের বেশি মান বেড়েছে মেক্সিকোর স্থানীয় মুদ্রার

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যাতে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় না আসে, তার জন্য দুই বছর ধরেই নানা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে প্রথম হাত দেয়া হয় দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণে। ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে দেশের আমদানি কমেছে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছর আমদানি কমতে পারে আরো ২৫ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে দুই অর্থবছরে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার আমদানি কমানোর প্রভাবও রিজার্ভে দৃশ্যমান নয়।

ডলারের প্রায় ৪০ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটানো ছাড়াও বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ নীতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে টাকা ডলারের অদল-বদল পদ্ধতিও চালু করা হয়। ডলারের ওপর চাপ কমাতে ঘোষণা দেয়া হয় রুপি, ইউয়ান, রুবলের মতো মুদ্রায় লেনদেন চালুর। ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি করা হয় আইএমএফের সঙ্গে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এত সব উদ্যোগের পরও দেশের রিজার্ভের ক্ষয় ঠেকানো সম্ভব হয়নি। যদিও প্রতিটি উদ্যোগ নেয়ার সময়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হয়েছিলএবার ক্ষয় বন্ধ হয়ে রিজার্ভ বাড়তে শুরু করবে

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল মনে করেন, রিজার্ভের ক্ষয় উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি গ্রহণে সময়ক্ষেপণ, অস্থিরতা আন্তরিকতার অভাবের ফল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, অনেক আগেই ডলারের বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের দরকার ছিল। কিন্তু সেটি করার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ হয়েছে। কারণে দেশে অবৈধ হুন্ডির বড় বাজার তৈরি হয়ে গেছে। মানুষ এখন নগদ ডলার সংস্থানের পাশাপাশি আমদানির জন্যও হুন্ডি কারবারিদের খোঁজে। অন্যদিকে ঋণের সুদহার বেঁধে রাখার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়া হয়েছে। সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও অনেক দেরি হয়ে গেছে। উভয় ক্ষেত্রেই নীতি গ্রহণে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তরিক ছিল না। কারণে রিজার্ভের ক্ষয় উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।

তবে বিষয়ে বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হককে পাওয়া যায়নি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন