রাজস্বে পরোক্ষ কর ও শুল্ক নির্ভরতা মূল্যস্ফীতি উসকে দেবে?

নজরুল ইসলাম

ফাইল ছবি

প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা জোগান দেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মধ্যে আয়কর থেকে আসবে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ শতাংশ বা মোট লক্ষ্যমাত্রার এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ আহরণ হবে পরোক্ষ কর ও শুল্ক থেকে। বরাবরের মতো এবারো রাজস্বের সিংহভাগ পরোক্ষ কর ও শুল্ক থেকে আহরণের লক্ষ্য দেশের মূল্যস্ফীতি আরো উসকে দিতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

তারা বলছেন, নতুন করে বেশকিছু খাতে আরো ভ্যাট আরোপ এবং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। নতুন বাজেট প্রস্তাবের মাধ্যমে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি একটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বছরে চারবার জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি শুল্ককে যে ছাড় দেয়া হয়েছে, তা আমদানিকারকদের পকেটে ঢুকে যাবে। এটা থেকে খুব বেশি সুফল আসবে না। ফলে প্রস্তাবিত বাজেট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বদলে এটা আরো উসকে দেবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এনবিআরের মোট রাজস্ব আহরণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ কর (আয়কর ও ভ্রমণ কর) থেকে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৩৬ শতাংশ। বাকি ৬৪ শতাংশ আসবে পরোক্ষ কর (আমদানি-রফতানি পর্যায়ে শুল্ক ও জাতীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর ও অন্যান্য খাত) থেকে। এর মধ্যে আমদানি-রফতানি পর্যায়ে শুল্ক খাত থেকে ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ টাকা। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ২৭ শতাংশ। জাতীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর ও অন্যান্য খাতের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৫১ হাজার ৭০০ টাকা। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ শতাংশ।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) খাত থেকে সর্বোচ্চ ৩৭ শতাংশ কর আহরণ করেছে। আয়কর থেকে ৩৪ এবং কাস্টমস (শুল্ক) থেকে ২৯ শতাংশ কর আহরণ করেছে। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা বেশি ছিল।

এ প্রসঙ্গে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, ‘এনবিআরের আয় বাড়ানোর পথ হচ্ছে প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়ানো। পরোক্ষ করে কখনো অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা আসে না। পরোক্ষ করমুখী হওয়া মানেই দ্রব্যমূল্য বা মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া। এবারের বাজেটটা পরোক্ষ করমুখী হয়ে গেছে।’

এবারের বাজেট সংকোচনমূলক মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সব ভালো। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো- যদি রাজস্ব আহরণ না হয়। বাজেট কমিয়ে যে সেটা বাস্তবায়ন করা যাবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ঘোষণা নেই। পদক্ষেপের বিষয়ে সুচিন্তিত কোনো ঘোষণা নেই।’

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটের রাজস্ব জোগান দিতে আমদানি-রফতানি পর্যায়ে শুল্ক করের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ২৬ শতাংশ। জাতীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর ও অন্যান্য খাতে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ শতাংশ। আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ শতাংশ বা মোট লক্ষ্যমাত্রার এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ কর (আয়কর ও ভ্রমণ কর) থেকে রাজস্ব আহরণ হবে ৩৭ শতাংশ। বাকি ৬৩ শতাংশ আসবে পরোক্ষ কর (আমদানি-রফতানি পর্যায়ে শুল্ক ও জাতীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর ও অন্যান্য খাত) থেকে।

এ তিনটি লক্ষ্যমাত্রার খাত ও মাসভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করে রেখেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আগামী জুলাই থেকে এসব কর আহরণ শুরু হবে।

এনবিআরের সাবেক সদস্য (আয়কর নীতি) সামস উদ্দিন আহমদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রত্যক্ষ কর আস্তে আস্তে বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ট্রেন্ড হচ্ছে পরোক্ষ করে জোর দেয়া। উন্নত দেশগুলো প্রত্যক্ষ করে জোর দেয়। আমাদের দেশে ভ্যাটে আরো জোর দেয়া যায়। তবে আগামী ২০ বছরে প্রত্যক্ষ কর আরো বাড়বে।’

অনেকের অভিযোগ পরোক্ষ করে নির্ভরশীলতা বাড়লে দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি বাড়ে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৭৯টি দেশে ভ্যাট চালু রয়েছে। ভ্যাট মানে কনজাম্পশন ট্যাক্স, এক্সপেনডিচার ট্যাক্স। মূল্য বাড়ার চিত্র বাংলাদেশের একক চিত্র না।’

প্রত্যক্ষ কর আদায় না বাড়াতে কোনো মহলের চাপ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এরকম কোনো কিছু আমি কখনো দেখিনি। আমি চাই কর সংস্কৃতি পরিবর্তন হোক। করদাতারা নিজেরা স্ব উদ্যোগে কর দিক। তার কাছে চাইতে হবে না।’

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১০ মাসে আদায় করা ২ লাখ ৮৯ হাজার ৩৭৭ কোটি ২২ লাখ টাকার রাজস্বের মধ্যে প্রত্যক্ষ কর (আয়কর ও ভ্রমণ কর) ৯৩ হাজার ১৪৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। তবে এনবিআরের আয়কর নীতি বিভাগ বণিক বার্তাকে জানিয়েছে, জুন পর্যন্ত ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকার প্রত্যক্ষ কর (আয়কর ও ভ্রমণ কর) আহরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে আয়কর বিভাগের।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, প্রত্যক্ষ করের বিশাল একটি অংশ আহরণ করে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে আয়কর বিভাগ প্রত্যক্ষ কর আহরণ করেছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে এলটিইউর আহরণ ছিল ২৫ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষ করের ২২.৮১ শতাংশ কর আহরণ করেছে এলটিইউ। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এলটিইউর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে এলটিইউকে কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ শতাংশ বেশি। পরে সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়। তবে এ লক্ষ্যমাত্রার কত শতাংশ আহরণ করেছে এলটিইউ, তা এখনো প্রকাশ করা হয়নি। এছাড়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তাদেরকে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা এখনো জানা যায়নি।

এনবিআরের সাবেক সদস্য (আয়কর নীতি) আলমগীর হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভ্যাটের আওতা এখনো বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। সে কারণেই হয়তো এদিকে নির্ভরতাটা বেশি। আমদানি শুল্ক কমিয়েও তো দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না। সে কারণেই হয়তো এদিকে নির্ভরতা বেশি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন