আস্থা পুনর্গঠন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বার্তা দিয়ে ঢাকা ছাড়লেন ডোনাল্ড লু

নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি অতিথি ভবন পদ্মায় গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে ডোনাল্ড লু ছবি: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

আস্থা পুনর্গঠন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াইয়ের বার্তা দিয়ে ঢাকা ছেড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তিনদিনের সফরে তিনি মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকায় আসেন। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার পর ডোনাল্ড লু আজ ভোর পৌনে ৪টার দিকে ঢাকা ত্যাগ করেন। 

সফরের দ্বিতীয় দিন গতকাল সকালে ডোনাল্ড লুর নেতৃত্বে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করে মার্কিন প্রতিনিধি দল। এরপর সরকারি অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন লু। পরে বৈঠক হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উত্তর আমেরিকা উইংয়ের মহাপরিচালক খন্দকার মাসুদুল আলম প্রমুখ। সফরের প্রথম দিন মঙ্গলবার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে ডোনাল্ড লুর নেতৃত্বে সফরে আসা প্রতিনিধি দলটি। ওইদিন রাতে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বাসভবনে নৈশভোজে অংশ নেন লু।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে সফরের আলোচনা নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন ডোনাল্ড লু। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমাদের জনগণের মধ্যে আস্থা পুনর্গঠনের চেষ্টার জন্য আমি দুদিন ধরে বাংলাদেশ সফর করছি। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে অনেক উত্তেজনা আমরা দেখেছি। যুক্তরাষ্ট্র এখানে অবাধ, সুষ্ঠু ও অহিংস নির্বাচনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছে। তবে আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই, পেছনে ফিরতে চাই না। আমরা আমাদের সম্পর্ককে শক্তিশালী করার উপায় খুঁজতে চাই।’ 

বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে ডোনাল্ড লু বলেন, ‘আমি আজ আমাদের সম্পর্কের কঠিন সমস্যা (হার্ড ইস্যুজ) নিয়ে কাজ করার বিষয়ে কথা বলেছি। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অংশীদারত্ব রয়েছে, যেমন র‍্যাবের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, শ্রম সংস্কার রয়েছে, মানবাধিকার রয়েছে, ব্যবসায়িক পরিবেশ সংস্কার রয়েছে। কাজ করার জন্য ইতিবাচকভাবে আমরা সহযোগিতার হাত বাড়াতে চাই। আমরা নতুন বিনিয়োগের বিষয়ে কথা বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য আরো বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসার বিষয়ে কথা বলেছি। পরিচ্ছন্ন জ্বালানি নিয়ে একসঙ্গে কাজের বিষয়ে কথা বলেছি। আমি মন্ত্রীর (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) সঙ্গে আলোচনা করেছি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে। সরকারের স্বচ্ছতা, কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতাকে আরো উন্নত করতে অনেক কিছুই করতে পারি আমরা। সাম্প্রতিক সময়ে মন্ত্রী আমাদের আহ্বান জানিয়েছেন, করভিত্তি প্রসারিত করতে বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য, যাতে সব বাংলাদেশী রাজস্বে অবদান রাখতে পারে।’ 

লুর সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো সরকার গঠনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তিনি তার চিঠিতে দুই দেশের সম্পর্ককে উচ্চতর ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। সে অভিপ্রায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফরে এসেছেন।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‌আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক খুবই চমৎকার। বহুমাত্রিক সহযোগিতার ক্ষেত্র রয়েছে। একই সঙ্গে গত ৫৩ বছরে আমাদের অভিযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে সফরে আসা মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছি।’

বাণিজ্য-বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘‌একক দেশ হিসেবে আমাদের রফতানির সবচেয়ে বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশও যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে নির্মীয়মাণ ৪০টি আইটি ভিলেজে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ডোনাল্ড লুকে অনুরোধ জানিয়েছি, কিছু বিনিয়োগ তারা এরই মধ্যে করেছে। ডোনাল্ড লু বলেছেন আমাদের ব্যবসাকে আরো সম্প্রসারিত করার জন্য জিএসপি সুবিধাকে তারা ফিরিয়ে দিতে চান। সেজন্য আমাদের লেবার পলিসিটা একটু রিভিউ করতে হবে, যেটি আমরা করছিও। সেটি নিয়ে গতকাল আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।’

অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ডোনাল্ড লু জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ শক্তিশালী করার জন্য তাদের ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন (ডিএফসি) থেকে অর্থায়ন করতে চায়। একই সঙ্গে আমাদের ট্যাক্স সিস্টেমকে আধুনিক করার জন্য সহায়তা করতে চায়। ট্যাক্স ফাঁকি রোধে ট্যাক্স কালেকশনের ক্ষেত্রেও তারা আমাদের সহায়তা করতে চায়।’ 

বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়েও আলোচনা হয়েছে জানিয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘‌বিষয়টি মার্কিন বিচার বিভাগের আওতাভুক্ত। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য বিভাগগুলোর হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কিন্তু তাদের বিচার বিভাগের সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাসের যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কাজ এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে।’

মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের পরই সবচেয়ে বেশি ত্রাণসহায়তা দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘লু জানিয়েছেন, এ সহায়তা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করবেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যুক্তরাষ্ট্রকে আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।’

হাছান মাহমুদ বলেন, ‘‌গাজায় শান্তি স্থাপনের বিষয়েও আমরা আলোচনা করেছি। ডেনাল্ড লু বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার, সেক্রেটারি অব স্টেট মিস্টার ব্লিঙ্কেন অক্লান্তভাবে কাজ করছেন, যাতে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। তিনি আমাকে বলেছেন তারা আশাবাদী। আমরা বলেছি, গাজায় যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, নিরীহ শিশুদের, নারীদের হত্যা করা হচ্ছে, ৩৫ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তার মধ্যে ৭০ শতাংশ নারী ও শিশু। এটি আসলে মেনে নেয়া যায় না। সেখানে শান্তি স্থাপন করা দরকার। তিনিও তাতে একমত।’

ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘‌বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা যাতে আরো ব্যাপকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে যায়, ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারে সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সহায়তা করতে চায়। আমি প্রস্তাব দিয়েছি যেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে তাদের এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চালু করা হয়। তারা নারী ক্ষমতায়ন ও জলবায়ু ইস্যুতেও সহায়তাদানের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে।’ ভিসা নীতির প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‌ইউএস ভিসা পলিসি ইজ ডরম্যান্ট নাউ। সুতরাং এটি নিয়ে আলোচনা হয়নি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন