প্রত্যাশিত চীনা বিনিয়োগের ঘোষণা না আসায় পুঁজিবাজারে দরপতন

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গতকাল একদিনে সূচকের পতন হয়েছে ৬২ পয়েন্ট বা ১ শতাংশের বেশি। দিন শেষে ডিএসইর সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স স্থির হয়েছে ৫ হাজার ৫০৭ পয়েন্টে। সারা দিনে লেনদেনের পরিমাণ কমেছে ৩১ শতাংশ। বাজার পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, সরকারপ্রধানের সর্বশেষ চীন সফর চলাকালে দেশটি থেকে প্রত্যাশিত অর্থ সহায়তা ও বিনিয়োগের ঘোষণা না আসার বিষয়টি পুঁজিবাজারে গতকালের এ নিম্নমুখিতায় প্রভাব ফেলেছে। 

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের আগে দেশটি থেকে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তা পাওয়া যাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছিল। যদিও সফর শেষে এ প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি সামান্যই। এ সময় দেশটি থেকে শুধু ১ বিলিয়ন রেনমিনবি বা ১ হাজার ৬১৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের এ সময়ে চীনের কাছ থেকে বড় অংকের অর্থ সহায়তা পাওয়া গেলে সেটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করতে পারত বলে মনে করছেন বাজার পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, এ অবস্থায় প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার বিষয়টি গতকাল দেশের পুঁজিবাজারে বড় দরপতনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। 

পাশাপাশি তহবিল সংকট, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিনিয়োগযোগ্য শেয়ারের অভাব ও প্রত্যাশিত দর সংশোধনের মতো বিষয়গুলোও পুঁজিবাজারের পয়েন্ট হারানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে জানিয়েছেন তারা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে গতকাল লেনদেন শুরুর পর থেকেই সূচকে অস্থিরতা দেখা গেছে। যদিও প্রথম ঘণ্টার লেনদেন শেষে ঊর্ধ্বমুখী অবস্থানেই ছিল ডিএসইর সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স। অবশ্য এর পর থেকেই শেয়ার বিক্রির চাপে পয়েন্ট হারাতে থাকে সূচক। দিন শেষে আগের দিনের তুলনায় ৬২ পয়েন্ট বা ১ শতাংশের বেশি কমে ৫ হাজার ৫০৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে সূচকটি। এদিন ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ কমেছে ৩১ শতাংশ। মোট লেনদেন হওয়া ৩৯৭টি শেয়ার, ডিবেঞ্চার, মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৩৬টির, কমেছে ৩৪৩টির আর অপরিবর্তিত ছিল ১৮টির বাজারদর।

দেশের পুঁজিবাজারে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকেই নিম্নমুখিতা দেখা যাচ্ছে। এ সময়ে সূচকের পাশাপাশি লেনদেনের পরিমাণও ক্রমেই কমছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামষ্টিক অর্থনীতির নানামুখী সংকট ও সুদহার বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো বাজারকে বেশ প্রভাবিত করেছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) রিভিউ মিশন, চলতি অর্থবছরের বাজেটের মতো বিষয়গুলোও বিনিয়োগকারীদের নজরে ছিল। আইএমএফের ঋণ অনুমোদন হলেও বাজেটে ব্যক্তির মূলধনি মুনাফায় করারোপের প্রস্তাব বাজারে বেশ প্রভাব ফেলেছে। দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে নাজুক ও স্পর্শকাতর ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এ বছরের জুন শেষে ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর থেকে প্রথমবারের মতো নিট বৈদেশিক রিজার্ভ সংরক্ষণে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব অর্থনীতি তথা পুঁজিবাজারের ওপর পড়েছে। এতে পুঁজিবাজারে টানা কিছুদিন ঊর্ধ্বমুখিতা দেখা গেছে। দেশের অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে বৈদেশিক উৎস থেকে পাওয়া ঋণ বা সহায়তা রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ানোয় সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এ কারণে সরকারের দিক থেকেও বৈদেশিক অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারপ্রধানের চীন সফরের সময় দেশটি থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা পাওয়া যাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত ১ বিলিয়ন রেনমিনবির প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।

যদিও এর সঙ্গে পুঁজিবাজারে গতকালের দরপতনের তেমন কোনো সংযোগ নেই বলে দাবি করছেন ডিএসই কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টানা কয়েকদিন পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী ছিল, ফলে এক্ষেত্রে কিছুটা দর সংশোধন হবে এটাই প্রত্যাশিত। তাছাড়া সেকেন্ডারি মার্কেটে টেকনো ড্রাগসের শেয়ার কেনার জন্য গতকাল কিছু ট্রেডার শেয়ার বিক্রি করে পুঁজি হাতে রেখেছেন, বাজারে দরপতন হওয়ার এটি একটি কারণ। বিদেশ থেকে বড় অংকের অর্থ এলে সেটি অবশ্যই দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারের ভালো হতো। তবে গতকালের দরপতনের সঙ্গে এর তেমন কোনো সংযোগ নেই।’

২০১৮ সালে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে শেনঝেন-সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের কনসোর্টিয়ামের কাছে প্রায় ৯৪৭ কোটি টাকায় ডিএসইর ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করা হয়েছিল। পাশাপাশি সে সময় চীনা কনসোর্টিয়ামের পক্ষ থেকে ডিএসইকে ৩ কোটি ৭১ লাখ ডলারের বেশকিছু কারিগরি সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। যদিও এখন পর্যন্ত এ কৌশলগত বিনিয়োগের তেমন কোনো সুফল দৃশ্যমান হয়নি। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে চীনের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টানা দুই মাস ধারাবাহিকভাবে পুঁজিবাজার নিম্নমুখী ছিল। তারপর ঈদের দু-একদিন আগে থেকে বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। এ অবস্থায় একটি দর সংশোধন প্রত্যাশিত ছিল। বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসবে এটিও একটি প্রত্যাশার বিষয় ছিল। তবে এটি এমন নয় যে আমাদের প্রাপ্য ছিল আমরা পাইনি। ফলে এর প্রভাবে পুঁজিবাজারে দরপতন হয়েছে বিষয়টি এমন নয়।’ 

দেশের পুঁজিবাজার চীনের কৌশলগত বিনিয়োগের কতটুকু সুফল ভোগ করতে পেরেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি খুবই হতাশাজনক যে কৌশলগত বিনিয়োগের কোনো ধরনের দৃশ্যমান সুফল আমরা এখনো দেখতে পাইনি। এ বিনিয়োগের ফলে স্টক এক্সচেঞ্জের পরিধি বাড়েনি। এক্সচেঞ্জের কার্যক্রম ও অপারেশনে কোনো পরিবর্তন আসেনি, কোনো আন্তর্জাতিক আইপিও আসেনি। ক্রস লিস্টিং হচ্ছে না, বিদেশী বিনিয়োগও আসছে না। শুধু কিছু প্রযুক্তিগত সহায়তা এসেছে। অথচ কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে ডিএসইর ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রির মূল উদ্দেশ্যই ছিল এটি আমাদের পুঁজিবাজারকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাবে। এটি আমাদের ব্যর্থতা বলতে হবে। স্টক এক্সচেঞ্জের কর্তৃপক্ষ কৌশলগত বিনিয়োগের সুফল আদায়ে ব্যর্থ। অন্যদিকে কৌশলগত বিনিয়োগকারীর দিক থেকেও কার্যকর কোনো ভূমিকা দৃশ্যমান নয়।’

দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ ক্রমেই কমে আসছে। গত ছয় মাসে পুঁজিবাজারের লেনদেন ধারাবাহিকভাবে কমেছে। সর্বশেষ গত জুনে এক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন হয়েছে পুঁজিবাজারে। এ সময়ে সব শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার ছেড়ে চলে গেছেন এক লাখেরও বেশি বিনিয়োগকারী। বিদেশীদের বিনিয়োগও ক্রমেই নিম্নমুখী। এ অবস্থায় সার্বিক অর্থনীতির উন্নতি ও বিদেশী বিনিয়োগ না এলে বাজার পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের কাছে পুঁজির ঘাটতি রয়েছে। যে পরিমাণ বিনিয়োগ আসছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণে পুঁজি বেরিয়ে যাচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও পুঁজিবাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সুদহার, রফতানি প্রবৃদ্ধি এসব সূচক যদি আমাদের অনুকূলে না আসে, তাহলে পুঁজিবাজারের অবস্থা পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। অর্থনীতি ঘুরে না দাঁড়ালে পুঁজিবাজার এগোবে না। পুঁজিবাজারকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। বিদেশী অর্থায়নও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ ও পোর্টফোলিও বিনিয়োগ। আমাদের এখানে বিদেশী পোর্টফোলিও বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। সুদের হার কমে আসার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি থেকে মুক্তি না মিললে বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে না। এছাড়া আগের তুলনায় বর্তমানে বিনিয়োগ করার মতো ভালো শেয়ারের সংখ্যা কমে গেছে। এর মানে বিনিয়োগ করার সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে। অন্যদিকে বর্তমানে গ্যাম্বলিং শেয়ারে বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন