এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির দশম সমাবর্তন

আচার্য স্বর্ণপদক জয়ীদের সাফল্যগাথা

ছবি : বণিক বার্তা

শিক্ষাজীবনে অসামান্য অবদানের জন্য আচার্য বা রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পেয়েছেন দেশের স্বনামধন্য বেসরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির (ইউএপি) নয় কৃতী শিক্ষার্থী। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির দশম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা এ স্বর্ণপদক পান। উচ্চ শিক্ষায় অনন্য মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ শিক্ষার্থীদের স্বর্ণপদক জয়ের পেছনের গল্প ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা শুনেছেন শফিকুল ইসলাম

মধ্যবিত্ত পরিবার হওয়ায় অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে

আদীব আশহাব অংকন

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

আমার পুরস্কারটি ব্যাচের নামে উৎসর্গ করতে চাই। এটি আমার বিভাগের জন্য একটি অনন্য পুরস্কার। কারণ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকৌশল বিভাগগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম কঠিন বিভাগ। সিজিপিএ ৪-এর মধ্যে ৩.৯৯-এর মতো একটি অসাধারণ স্কোর অর্জন খুব কঠিন। কঠোর পরিশ্রম, সততা, সময় ব্যবস্থাপনা এবং ভালো বন্ধু সবই গুরুত্বপূর্ণ। কঠোর পরিশ্রমের পরিপ্রেক্ষিতে, প্রতিটি কোর্সের পুঙ্খানুপুঙ্খ বোঝার জন্য আমি যা করতে পারি তা চেষ্টা করতাম। কখনই চূড়ান্ত ফল নিয়ে ভাবতাম না। আমার সেরাটা করার চেষ্টা করতাম। সময় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সচেতন ছিলাম। দৈনন্দিন কাজগুলো কখনই ফেলে রাখতাম না, সময়ের কাজ সময়ে করার চেষ্টা করতাম। আমি আমার দৈনন্দিন জীবনে সময়নিষ্ঠ ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি ক্লাবে জড়িত ছিলাম। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কালচারাল ক্লাব, সেন্ট্রাল কালচারাল ক্লাব, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাব, এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাব, জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাব, ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাব এবং ফিল্ম ক্লাবের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। এ সম্পৃক্ততা আমাকে মাল্টিটাস্কিং এবং সময় ব্যবস্থাপনা দক্ষতা উন্নত করতে সাহায্য করেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য হওয়ায় আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমি কখনই এ বাধাগুলোকে আমার দুর্বলতা হতে দিইনি। আমার পড়াশোনার বিষয়ে ইতিবাচক ছিলাম, যা আমার জীবনে উদ্ভূত যেকোনো অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।

সেমিস্টার ফি থেকে মুক্তি পেতেই ভালো ফলাফল করা

মো. রমজান আলী

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক অবশ্যই অনেক বড় একটি অর্জন। মাহেন্দ্রক্ষণ জীবনে একবারই আসে। প্রিয় শিক্ষক, সিনিয়রদের সাফল্যের গল্প আর নিজের ইচ্ছাশক্তি- তিনের সংমিশ্রণ আমাকে ভালো ফলাফলের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা % শিক্ষার্থীর সেমিস্টার ফি মওকুফ করা হয়। প্রতি সেমিস্টারে আমার লক্ষ্য ছিল কীভাবে সেমিস্টার ফি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। বলতে গেলে সেমিস্টার ফি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই ভালো ফল করা।

আর অর্জনে এটিই ছিল অনুপ্রেরণা। অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল, সেগুলো এখনো রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি সেটি হলো ইংরেজি ভাষার দক্ষতা। ইংরেজিতে দক্ষ হওয়া ছাড়া উচ্চ শিক্ষায় ভালো অর্জন সম্ভব নয়। নেতিবাচক মনে হলেও কেন জানি আমার কাছে ইউটিউবার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, ফ্রিল্যান্সার হয়ে জীবন অতিবাহিত করা সহজ মনে হচ্ছে। আমাদের সমাজ বাস্তবতায় শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি বড় কিছু করা কঠিন।

জীবনের প্রতিটি কাজেই দায়িত্বশীল হতে হবে

আফিয়া আলম

ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ

 আমি এবং আমার বোন লামিয়া আলম দুজনেই একসঙ্গে রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছি। এটি আমাদের পরিবারের জন্য অনেক বড় পাওয়া এবং সম্মানের। সব থেকে বড় পাওয়া আমাদের কাছের মানুষদের সামনে পদক গ্রহণ করা। পদক অর্জনের পেছনে ভালো ফল দরকার হয়েছে আর ভালো ফলের জন্য সর্বপ্রথম যে বিষয়টি দরকার তা হলো তীব্র ইচ্ছা। এছাড়া ক্লাসে মনোযোগী হতে হবে। যতটুকু সময় পড়ার জন্য রাখি না কেন ওই সময়টুকু পুরোপুরি পড়ার পেছনেই দিতে হবে। পরিবারের সহায়তায় তেমন কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি। মহান আল্লাহ আমাদের পথ সবসময় সুগম রেখেছেন, আলহামদুলিল্লাহ। নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য আমার পরামর্শ থাকবে সবসময় ক্লাসে মনোযোগী থাকতে হবে। শিক্ষকদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। জীবনের প্রতিটি কাজেই দায়িত্বশীল হতে হবে। শুরু থেকেই আমার ইচ্ছা শিক্ষক হওয়ার। আমি ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হতে চাই। ইচ্ছা সামনে রেখেই সব পরিকল্পনা। এমবিএ শেষ করেই শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করতে চাই।

প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে

লামিয়া আলম

ফার্মেসি বিভাগ

রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক অর্জন ছিল ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগা কাজ করেছে যেই জায়গাটিতে সেটি হলো দুই বোন একসঙ্গে স্বর্ণপদক গ্রহণ করতে পেরেছি। আমরা দুই বন যমজ এবং একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছি। যদিও দুজনের বিভাগ ছিল আলাদা। কিন্তু আমরা দুজনে একসঙ্গে রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক নিতে পেরেছি এটা আমাদের জন্য এবং পরিবারের জন্য সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয়। ভালো ফলের জন্য সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে সময় ব্যবস্থাপনা। এটিই অর্জনের পেছনে জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে। অবশ্যই অধ্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভালো রেজাল্টের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল আম্মুর এবং বোনের। আমরা দুই  বোন সবসময় একসাথে পড়াশোনা করেছি এবং পড়ার সময় বোন সঙ্গে থাকায় অনেক বড় একটা সাপোর্ট হিসেবে কাজ করেছে। এ অর্জনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা নিজেকেই মনে হয়েছে। প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কারণ পড়তে ইচ্ছে করত না। সবসময় মনে হতো বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরি কিংবা পড়াশোনা বাদে অন্য জিনিসের প্রতি আগ্রহ ছিল বেশি। কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করে নিজেকে বুঝিয়ে পড়তে বসানোটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জটাকে মোকাবেলা করতে পেরেছি নিজের ইচ্ছাগুলোকে দমিয়ে রেখে পড়তে পেরেছি এবং পরীক্ষার পর নিজের ইচ্ছাগুলো পূরণও করতে পেরেছি এটাই ছিল সবচেয়ে বড় সার্থকতা। নবীনদের প্রতি আমার পরামর্শ সময় ভাগ করে পড়াশোনা করার। একই সঙ্গে পড়াশোনাটা যেমন জরুরি ইউনিভার্সিটি জীবন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কাটানোও জরুরি।

আমার স্বপ্ন নতুন ওষুধের আবিষ্কার 

সানজিদা আহমেদ

ফার্মেসি বিভাগ

রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পেয়ে আমার অত্যন্ত ভালো লাগছে এবং আনন্দিত বোধ করছি। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছি, তাই দশম সমাবর্তনে অংশ নিতে পারিনি এবং সরাসরি স্বর্ণপদক গ্রহণ করতে না পারাটা আমার জন্য খুবই কষ্টের। তবে পদকটি পাওয়ার মাধ্যমে আমার কঠোর পরিশ্রম ও উৎসাহের স্বীকৃতি মিলেছে, যা আমাকে আরো অনুপ্রাণিত করেছে। সুনির্দিষ্ট পড়াশোনার কৌশল, নিয়মিত ক্লাস অনুসরণ এবং সহপাঠীদের সঙ্গে জ্ঞান বিনিময় আমার ভালো ফল অর্জনে সহায়ক হয়েছে। এর পেছনে প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিল মানসিক চাপ এবং সময় ব্যবস্থাপনা। এ চ্যালেঞ্জগুলো সামলানোর জন্য আমাকে সঠিক পরিকল্পনা এবং ধৈর্য ধারণ করতে হয়েছিল। নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার পরামর্শ, নিয়মিত পড়াশোনা এবং সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ। ক্লাসে নিয়মিত অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রমে যোগ দিন, যা আপনার শিক্ষাজীবনকে আরো সমৃদ্ধ করবে। এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন, কারণ এটি আপনার শিক্ষাগত প্রগতি এবং সার্বিক কল্যাণে অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যতে আমি ফার্মেসির ক্ষেত্রে একজন গবেষক হতে চাই এবং গবেষণা ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে চাই। আমার স্বপ্ন নতুন ওষুধের আবিষ্কার এবং এর ক্লিনিক্যাল প্রয়োগ নিয়ে কাজ করা। এ উদ্যোগের মাধ্যমে আমি স্বাস্থ্যসেবায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চাই।

অধ্যবসায় ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য ভালো ফলাফলে সাহায্য করেছে

মাহাবুব এলাহী 

কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

এটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় মুহূর্ত। ধন্যবাদ জানাই মহান রাব্বুল আলামিনকে এবং আমার পরিবারকে যারা আমার ওপর অগাধ বিশ্বাস রেখেছিল। অধ্যবসায় ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য ভালো করতে সাহায্য করেছে। সবসময় চেষ্টা করতাম প্রতি সেমিস্টারের প্রতি ক্লাস এবং পরীক্ষাগুলোয় অংশগ্রহণ করার, পড়ালেখার পাশাপাশি নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির পেছনে সময় দিতাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি এবং এরই ফলে আমি ব্লকচেইন অলিম্পিয়াড বাংলাদেশ ২০২১ এবং আন্তর্জাতিক ব্লকচেইন অলিম্পিয়াড ২০২১-এর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করি। ছোটবেলা থেকেই আমার ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার পর যখন কোথাও এ বিষয়ে পড়ার সুযোগ না হয় তখন হতাশই হয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে পড়ার সুযোগ পেয়েও ভর্তি হইনি। পরিবারের শত বাধা সত্ত্বেও ইউএপিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। এই সময়টা আমার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল, নিজেকে সবসময় প্রমাণ করতে হয়েছে আমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। নবীন শিক্ষাথীদের জন্য পরামর্শ নিজের একটি লক্ষ্য ঠিক করে তার পেছনে সময় দাও, আর শুধু ভালো ফলের পেছনে না ছুটে নিজেকে দক্ষ মানুষ হিসেবে গড়ে তুললে সফলতা আসবেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন