বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অধ্যাপক রেহমান সোবহান

দুদক ও নির্বাচন কমিশনসহ জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানই কাজ করছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : সংগৃহীত

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও নির্বাচন কমিশনের মতো জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানই কাজ করছে না বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, ‘‌আমরা এখন গণতন্ত্রের অবক্ষয় দেখছি। সুবিধা নিতে নতুন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী রাজনীতিতে আসছে। লাখো মানুষের সঞ্চয় ঋণখেলাপিদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে।’

গতকাল ‘ফিফটি ইয়ার্স অব বাংলাদেশ: ইকোনমি, পলিটিকস, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান। অনুষ্ঠানে বইটির লেখক ও পর্যালোচকরা বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে লিখিত বইটি সম্পাদনা করেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও রওনক জাহান। এতে ১৫ জন লেখক রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে রেহমান সোবহান বলেন, ‘‌২৫ বছর আগেও দেশের পোশাক খাত টেইলরিং শিল্প ছিল। রেমিট্যান্স কম ছিল। শিল্পের বহুমুখীকরণ ছিল দুর্বল। কিন্তু গত ২৫ বছরে অনেক ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। শিল্পের বিকাশ হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচন হয়েছিল। এ পদ্ধতি নেপাল ও পাকিস্তান গ্রহণ করেছিল। দুই দলের অংশগ্রহণে রাজনীতিতে ভারসাম্য এসেছিল। কিন্তু এখন আমরা কোথায় আছি?’

তিনি আরো বলেন, ‘‌এখন আমরা গণতন্ত্রের অবক্ষয় দেখছি। সুবিধা নিতে নতুন একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী রাজনীতিতে আসছে। সবাই কি একই বিচার পাচ্ছে? পুলিশ কি সবাইকে একই সেবা দিচ্ছে? ব্যাংক থেকে সবাই একইভাবে ঋণ পায়? জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। কিন্তু দুদক ও নির্বাচন কমিশনের মতো কোনো জাতীয় প্রতিষ্ঠানই কাজ করছে না।’

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান বলেন, ‘‌বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আগে আরেকটি বই লিখেছিলাম আমরা। তখন ভেবেছিলাম বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে ভালো জায়গায় যাবে। কিন্তু এখন ততটা আশাবাদী নই আমরা।’

বাংলাদেশের উন্নয়ন বিস্ময়করভাবে নয়, বরং স্বাভাবিকভাবে হয়েছে বলে মনে করছেন আইএলওর সাবেক কর্মকর্তা ড. রিজওয়ানুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘‌কৃষি ও শিল্প শ্রমিক এবং প্রবাসীদের শ্রমের মাধ্যমে দেশের উন্নতি সাধিত হয়েছে।’

গ্রামীণ সেচভিত্তিক কৃষি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও রেমিট্যান্স পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করছেন বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাতবিষয়ক সাবেক প্রধান সৈয়দ আখতার মাহমুদ। পরিবর্তনগুলো সরকারের মাধ্যমে নয়, বরং উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একধরনের সমন্বয়ে ঘটেছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি। যদিও সে সমন্বয় এখন সেভাবে কাজ করছে না বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশের সামনে ঋণফাঁদ এবং মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ার চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছেন বইটির আরেকজন লেখক সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘‌ব্রাজিল ৩৫ ও ফিলিপাইন ৩৩ বছর মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ে আছে। সেখান থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য উচ্চ প্রযুক্তির রফতানি প্রয়োজন। কিন্তু হাই-টেক রফতানি এখনো ১ শতাংশে আটকে আছে। যদিও ভিয়েতনাম তা ২৫ থেকে ৪৫ শতাংশে উন্নীত করেছে।’

অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আরো বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ‘‌সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমেই পোশাক খাত প্রাতিষ্ঠানিক হয়নি। শিল্পনীতিতে শুধু এ খাতই সুবিধা পাচ্ছে। তবে পরবর্তী পর্যায়ের প্রবৃদ্ধির জন্য প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ জরুরি। ব্যাংক ও করকাঠামোর উন্নতি হয়নি। বিদ্যমান দুর্নীতি এবং সংস্কারবিরোধী শক্তি উদ্বেগ তৈরি করছে। এটার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।’

বাংলাদেশ সস্তা শ্রমের অর্থনীতিতে আটকে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘‌শিক্ষা এক সময় সামাজিক উন্নতির চালক ছিল। কিন্তু এখন শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের সস্তা শ্রমের ফাঁদে আটকে ফেলেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যেও মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। অন্যদিকে দুর্নীতির মাধ্যমে ধনী তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে দেশ।’

দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বাড়ছে কেন? এ প্রশ্ন তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএম আকাশ। তিনি বলেন, ‘‌গড় প্রবৃদ্ধির হিসাবের মধ্যে একটি ফাঁকি লুকিয়ে আছে। এখানে বড়দের প্রবৃদ্ধি রকেটের গতিতে হলেও গরিবের হয়েছে শামুকের গতিতে। শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়লেও প্রকৃত মজুরি বরং কমেছে।’

রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক মির্জা এম হাসান। আগামীতে ব্যবসায়ীরাই রাজনীতির বড় মাতব্বর হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। আর দেশের রাজনীতিতে আগামীতে রক্ষণশীল ইসলামপন্থীরা আরো শক্তিশালী হবে বলে মনে করছেন আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আলী রিয়াজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনলাইনে সেমিনারে যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, ‘‌সরকার এক ধরনের ইসলামপন্থীদের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। সে শূন্যতা পূরণ করেছে রক্ষণশীল ইসলামপন্থীরা। তারা আগামীতে আরো শক্তিশালী হতে পারে।’

সরকারের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাত আরো বাড়বে বলে মনে করছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘‌রাষ্ট্র প্রভাবশালী নেতাদের ক্ষমতা প্রয়োগের অনুমতি দিচ্ছে। সব শক্তি প্রয়োগ করে বিরোধীদের শক্তিহীন করার চেষ্টা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলো পথ হারিয়েছে। এমন বাস্তবতায় আগামী দিনের রাজনীতির পথ কে দেখাবে?’

বইটির অর্থনীতিবিষয়ক প্রবন্ধ আলোচনার পর পর্যালোচনা করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘‌বাংলাদেশে বিস্ময়করভাবে উন্নয়ন হয়নি। বরং উন্নয়ন সত্ত্বেও কেন প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতি হয়নি সেটাই উল্টো বিস্ময়ের বিষয়। সবাইকে নিয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি। তাই দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বাড়ছে। শ্রমের মজুরি বাড়ছে না। ভাবষ্যৎকে বন্ধক রেখে উন্নয়ন করা হয়েছে। পরিবেশের প্রতি অন্যায় ব্রিটিশ আমলকেও ছাড়িয়ে গেছে। অলিগার্ক এলিটরা রাজনৈতিক সংযুক্তির জন্য বিনিয়োগ করছে। এটা ইন্স্যুরেন্সের মতো কাজ করছে। সর্বোপরি কার খরচে কার উন্নতি হয়েছে—সেটাই বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন