এএসএম
মাইনউদ্দিন মোনেম। দেশের নেতৃস্থানীয় কনগ্লোমারেট আব্দুল মোনেম লিমিটেডের (এএমএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাংলাদেশের নির্মাণ খাতে আব্দুল মোনেম এক পরিচিত
নাম। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, সাসেক ১ ও
২, চার লেনের সড়কসহ দেশের অনেক বড় বড় অবকাঠামো
গড়ে তুলেছে ১৯৫০-এর দশকে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান। নির্মাণ খাতের পাশাপাশি অর্থনৈতিক জোন, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, আর্থিক খাতসহ নানামুখী ব্যবসা করছে এএমএল। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে মাইনউদ্দিন
মোনেম বাবা আব্দুল মোনেমের গড়া এ শিল্প গ্রুপটির হাল ধরেছেন। এবারের আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার ঈদ উদযাপনের গল্প।
এ
বয়সে পৌঁছে ছোট্টবেলার কথা বললে বলতে হয়, ঈদের উৎসব আর আনন্দ মিলেমিশে একাকার
হয়ে যেত। আমার একদম ছোটবেলাটা কেটেছে ধানমন্ডি
লেকের পাড়ে কলাবাগানে। সকাল-বিকেল কলাবাগান মাঠে চলত আমাদের
খেলাধুলা। ফুটবল, হকি, ক্রিকেট—আমি ছিলাম সব খেলাতেই পটু। ঈদের দিন খেলার সব সাথিদের নিয়ে চলত
কম্পিটিশন। বিকালে প্রাইজ গিভিং সিরমনি।
আব্বা-আম্মা কিনে
দিতেন ঈদের নতুন জামাকাপড়। পাশাপাশি আমার ঘনিষ্ঠ কজন বন্ধুও একই কাপড় পেত। সকালে
দলবেঁধে ওই একই কাপড় পরে ঈদের নামাজ আদায় শেষে সারা পাড়া ঘুরতাম আর সব বাসায়
গিয়ে খেতাম—সেমাই, জর্দা, ফিরনি, পোলাও, গোশত। তার
আগে মায়ের হাতের সেমাই খেয়ে আব্বার সঙ্গে
যোগ দিতাম কলাবাগান মাঠের ঈদ জামাতে। কোলাকুলি করতাম ছোট-বড়
সবার সঙ্গেই।
ঈদের
অন্তত চার-পাঁচদিন আগে আব্বার সঙ্গে জাকাতের কাপড় দিতে যেতাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার
বিজেশ্বর, আমাদের গ্রামের বাড়ি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে
শাড়ি-লুঙ্গির সঙ্গে জাকাতের টাকা বিলিয়ে আসতাম। কাপড় আর টাকা পেয়ে সবাই ভীষণ
খুশি হতো। মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিত। তাদের দোয়া পেতে আমার বেশ ভালো লাগত।
গরিব-দুঃখীদের মাঝে সাহায্য দেয়ার অনুপ্রেরণাটা পেয়েছি আব্বার কাছ থেকে।
একটু
বড় হলে আমরা কলাবাগান ছেড়ে চলে এলাম গুলশানের বাসায়। এখানে এসে ঈদ একটু পাল্টে
গেল। কলাবাগানের মতো কেন জানি প্রাণবন্ত হতো না। আব্বার সঙ্গে আমরা
দিই ভাই নতুন কাপড় পরে যথারীতি যেতাম আজাদ মসজিদ মাঠে। ঈদের
বিশাল জামাত হয় সেখানে। চেনা মানুষের থেকে অচেনা মানুষের
সংখ্যাই বেশি। নামাজ শেষে পরিচিত যাদের পেতাম তাদের জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করতাম।
সংখ্যায় খুব কম। বাসায় ফিরে মাকে বলে চলে যেতাম কলাবাগানে।
পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে মিলে আগের মতো সবার বাড়ি বাড়ি
ঘুরতাম। সবাই জিজ্ঞেস করত, কেমন আছিস? বলতাম, ভালো। আসলে ভালো নেই। মনে মনে বলতাম, তোমাদের মিস
করি, ভীষণ মিস করি। সারাটা দিন কলাবাগানে কাটিয়ে সন্ধ্যায়
গুলশানের বাসায় ফিরতাম। এভাবেই কেটে যেত আমার বাল্যবেলার ঈদ।
এখন ঈদ
আমার জন্য আরো
বিস্তৃত হয়েছে। আমার প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেডের আওতাধীন
দেশের নানা প্রান্তে অবস্থিত নয়টি নির্মাণ সাইটের চারপাশের দুস্থ
এলাকাগুলোয় ঈদের দিন সময় কাটাই। আমার প্রতিষ্ঠানের
ফ্যাক্টরিগুলোয় ঈদ উপহার বিতরণ এবং আমাদের ‘এএমএল পরিবার’-এর সদস্যদের মাঝে ঈদ বোনাস বিতরণ করা
হয়। আমি আমার প্রিয় ও ঘনিষ্ঠ এএমএল সহকর্মীদের সঙ্গেই ঈদ কাটাই।
এটি আমার কাছে শুধু উৎসব নয়, বরং এটি এমন একটি সময় যখন আমি
আমাদের কর্মীদের সঙ্গে আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা ভাগাভাগি করি।
এছাড়া
আমি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে থাকি, যেমন—গরিব ও অসহায়
শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ বিতরণ, অভাবী পরিবারগুলোকে ঈদের খাদ্য ও পোশাক দেয়া এবং আমাদের কর্মচারীদের
জন্য বিশেষ ঈদ উদযাপনের আয়োজন। এসব
কার্যক্রমের মাধ্যমে আমি চেষ্টা করি এএমএল পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের মুখে হাসি ফোটাতে।
এ উদ্যোগগুলো আমায় মনে করিয়ে দেয়,
ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ব
পালনও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ঈদ আমাকে সহায়তা ও ভালোবাসার মাধ্যমে সমাজের সঙ্গে যুক্ত
থাকার অনুপ্রেরণা দেয়।
ঈদের
দুপুর ও সন্ধ্যা বেলা আমি এখন বেশির ভাগ সময় বাসায় কাটাই, আমার মা, মেয়ে জাইনাব, দুই ছেলে (যদি তারা দেশে থাকে, কারণ তারা যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করছে), আমার স্ত্রী এবং আমার বোনেরা ও তাদের সন্তানদের সঙ্গে। সারা দিন ধরে মায়ের বাসায়
আত্মীয়স্বজন আসে, যেন এক রকম খোলা বাড়ির মতো পরিবেশ।
বাবার
মৃত্যুর পর থেকে আমি ঈদের কয়েক দিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার চিরনিদ্রাস্থল
পরিদর্শন করি এবং সেখানকার মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি
করি। আজাদ মসজিদে বাবার সঙ্গে যাওয়ার ঐতিহ্য এখন আমার দুই ছেলের সঙ্গে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে পরিচিত
মুখের সংখ্যাও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
আমার
ঈদের আনন্দের একটি বড় অংশ হল যখন দেখি আব্দুল মোনেম লিমিটেডের নির্মিত
রাস্তাগুলো দিয়ে মানুষ নির্বিঘ্নে বাড়ি যাচ্ছে, যা নির্মাণ
খাতে আমাদের অবদানের একটি প্রতিফলন। আমার বাবা মরহুম আব্দুল
মোনেম ছিলেন এ দৃষ্টি ও উদ্যমের প্রথম প্রবর্তক। তিনি আমাকে
শিখিয়েছেন যে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে অবকাঠামো উন্নয়ন কতটা অপরিহার্য। তার
অধীনে, আমাদের কোম্পানি প্রথম থেকেই সেতু নির্মাণ, মহাসড়ক সম্প্রসারণ এবং রাস্তা মেরামতের মতো বহু জাতীয় প্রকল্পে অংশ
নিয়েছে, যা বাংলাদেশকে আধুনিক অবকাঠামোর দিক থেকে এক নতুন
মোড় নিতে সাহায্য করেছে।
আমাদের নির্মিত
অবকাঠামোগুলো কেবল দেশের ভৌগোলিক সীমানাকেই সংযুক্ত করেনি, ঈদের মতো উৎসবের সময় মানুষকে তাদের
প্রিয়জনের কাছে নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেয়ার মতো মানবিক সংযোগও
সৃষ্টি করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে আস্থা ও
নিরাপত্তার অনুভূতি বেড়েছে, যা সমাজের প্রত্যেক স্তরে
ফেলেছে ইতিবাচক প্রভাব। আমাদের তৈরি রাস্তা ও সেতুগুলো দেশের অগ্রযাত্রায় এক অপরিহার্য অধ্যায়ে পরিণত
হয়েছে, যার মাধ্যমে আমার ঈদের আনন্দ আরো বিস্তৃত ও অর্থপূর্ণ হয়।