আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন

বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঈদ উপহার দেয়ার কথা আজও মনে পড়ে

ছবি : বণিক বার্তা

আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ সম্পন্ন করে ১৯৯৩ সালে যুক্ত হন পারিবারিক ব্যবসায়। পেশাজীবনে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, মধুমতি ব্যাংকের পরিচালক ও সিটি ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানের মতো নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। এবারের আলাপচারিতায় শৈশবের ঈদ উদযাপনের গল্প শুনিয়েছেন তিনি। কথা বলেছেন বদরুল আলম

শৈশবে ঈদের বেশ আগেই জামাকাপড় কেনা শুরু করতাম। আমরা থাকতাম ঢাকার লালবাগে। তখন লালবাগে সব বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যার পর হারিকেন জ্বালিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জাকাত ও ঈদ উপহার দিয়ে আসার কথা আজও মনে পড়ে। বড়দের সঙ্গে আমাদের ছোট কাউকে পাঠানো হতো যেন আমরা কাজটা শিখতে পারি। শেষের কয়েক রোজায় আমরা রাতে এ কাজ করতাম। কেউ যেন বিব্রতবোধ না করে, সেজন্য আমরা দিনের বেলায় যেতাম না। আমাদের ঈদ শুরু হতো এভাবেই। 

আমাদের বাবা-চাচারা একসঙ্গে থাকতেন। স্বাভাবিকভাবে সবাই একসঙ্গে ঈদ উদযাপন করতাম। আমরা সাত ভাই-বোন; বড় চাচার সন্তান ১০ জন, মেজো চাচার তিনজন—অনেক মানুষ। আমরা যখন মসজিদে যেতাম একসঙ্গে যেতাম; একসঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তাম। 

ঈদের আগে মা-চাচিরা আমাদের নিয়ে কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকতেন। আমার খেয়াল আছে, ‘মাসকো সু’ বলে একটা জুতার দোকান আছে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে। ওই দোকান থেকে আমরা জুতা কিনতাম। তখন পোশাক বানাতাম; কেনার প্রবণতা ছিল কম। ‘ইন্টিমেট’ বলে একটা টেইলার শপ ছিল। ওদিকে গিয়ে সব ভাই-বোন মিলে একসঙ্গে পোশাক বানাতে দিতাম। 

ঈদের সময় আম্মা আর আব্বা খুব ব্যস্ত থাকতেন। চকবাজারে আমাদের কাপড়ের ব্যবসা ছিল, আব্বা সেখানে ব্যস্ত থাকতেন। আম্মা আমাদের কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আমি ঈদের দিন সকাল থেকেই ঈদির (সালামি) অপেক্ষায় থাকতাম। কে কত দিল, আর কে কত পেল, তা নিয়ে খুব হইহুল্লোড় হতো। আমার টাকা জমাতাম দাদুর কাছে। 

লালবাগ থেকে এক পর্যায়ে আমরা ধানমন্ডি চলে আসি। এখানে আসার পরও ঈদের দিন আমরা লালবাগ চলে যেতাম। ধানমন্ডিতে আসার পরও অনেক বছর আমরা লালবাগেই ঈদের নামাজ পড়েছি। তারপর ধানমন্ডিতে নামাজ পড়া শুরু করি। ঈদের সময় আমাদের বাসাটা গোটা পরিবারের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। সব চাচা, চাচাতো ভাই-বোন আমাদের বাসায় চলে আসত ঈদ করার জন্য। 

যারা একটু বয়সে বড় ছিল, তাদের কাছ থেকে ঈদি নিতাম, একপ্রকার হাইজ্যাক করতাম। সারাদিন এগুলোই চলত। সকালে আম্মার হাতের সেমাই খেতাম। খুব আনন্দে ঈদ কাটত। 

যেহেতু তিন চাচা একসঙ্গে থাকতেন, ফলে আমাদের বন্ধনটা খুব মজবুত ছিল। আমি যখন ১৯৯৩ সালে ব্যবসায় যোগ দিই, প্রথম তিন-চার বছর ঈদের নামাজ পড়ে একটু খেয়ে চলে যেতাম কারখানায়। কারখানা বন্ধ থাকত, কিন্তু কারখানায় লোক থাকত। আমি গিয়ে সবার সঙ্গে ঈদ করতাম এবং সবাইকে ঈদের বকশিশ দিতাম। ওটা করতে করতে বিকাল ৩টা-৪টা বেজে যেত। আমার মনে আছে, চার-পাঁচ বছর পর্যন্ত ঈদের দিন কারখানায় যেতাম। ঈদের দিন যেতাম কারণ আমার আব্বার শিক্ষা ছিল—যারা কারখানায় আছেন, তারা যেন অনুভব করেন যে ওদের কেউ আছেন। ওদের ছোট ছোট বাচ্চা থাকত, ওদের ২০ টাকার নতুন নোট দিতাম। এতে তারা অনেক খুশি হতো।

এখন আমার স্ত্রী-সন্তান দেশের বাইরে। কখনো দেশে ঈদ করছি, কখনো বিদেশে ঈদ করছি। কাজের চাপেই এমনটা হয়। যখন দেশে থাকি, সবাই আগের মতো আমাদের বাসায় চলে আসে। আব্বা মারা গেছে প্রায় আড়াই বছর আগে। কিন্তু আব্বার বন্ধুর ছেলেমেয়েরা চলে আসে। ঈদের দিন এখনো আমাদের বাসা জমজমাট থাকে।

আমার ছেলেকেও আমি একই কথা বলব। আমার বড় ছেলে দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিল। এ বছর সে ঈদের দিন চলে যাবে কারখানায়। সেখানে যারা থাকবে, তাদের সঙ্গে ঈদ করে তারপর আসবে। এ ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছি। ওরাও দাদার ঐতিহ্য সম্পর্কে জানে। আমাদের দেখেও শিখবে সে আশাই করি। 

শ্রুতিলিখন: আল ফাতাহ মামুন 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন