মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এমডি মোস্তফা কামাল

ঈদে কারখানা দেখতে যেতেই বেশি আনন্দ পাই

ছবি: বণিক বার্তা

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও এমডি মোস্তফা কামাল। ব্যবসার শুরুটা ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হলেও তার শিল্পের যাত্রা মেঘনা ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ দিয়ে। এ উদ্যোক্তা বর্তমানে অর্ধশতাধিক শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছেন, যেখানে কাজ করেন ৫০ হাজার কর্মী। এবারের আলাপচারিতায় এ শিল্পোদ্যোক্তা শুনিয়েছেন তার শৈশব ও বড়বেলার ঈদ উদযাপনের গল্প। লিখেছেন রাশেদ এইচ চৌধুরী

আমি গরিবের সন্তান। বাবা ছোটখাটো চাকরি করতেন। শৈশবেই চারদিকে অভাব-অনটন দেখেছি। ছাত্র অবস্থায় একটি সাইকেল কিনে দেয়ার সামর্থ্যও ছিল না পরিবারের। নানা বাধাবিপত্তি আর সংগ্রাম করেই এতটুকু আসা। শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা আমার কাছে নেশার মতো। শিল্প-কারখানা না হলে কর্মসংস্থান হবে না। কর্মসংস্থান না হলে সমৃদ্ধি আসবে না। মেঘনা গ্রুপ প্রতিনিয়ত বিনিয়োগ বাড়াতে কাজ করছে।

আমাদের ছোটবেলায় খুব অভাব ছিল। তাই এখনকার ঈদ উদযাপন তখনকার সঙ্গে কোনোভাবেই মেলানো যাবে না। তখনকার পরিস্থিতি মোটেও সহজ ছিল না। মা-বাবা নিজেরা খেয়ে না খেয়ে সন্তানদের খেতে দিতেন। আমরা যখন পড়ালেখা করি পাকিস্তান আমলে, তারপর স্বাধীনতা-পরবর্তী আরেক ধরনের সময় কেটেছে। আবার আশির দশকে কিংবা নব্বইয়ের দিকে একধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। পাকিস্তান আমলে যাদের কিছুটা সামর্থ্য ছিল তাদের ঘরে সেমাই রান্না হতো। রমজানের ঈদে রসের সিজন থাকলে সিন্নি পাক হতো। পিঠাপুলিও আয়োজন হতো। আর যাদের সামর্থ্য ছিল না তারা অন্যদের সহায়তা পেত। ঈদুল আজহায়ও দেখা যেত সাতজনে মিলে একটা পশু কোরবানি দিত। আমাদের গ্রামের একজন ঢাকায় দোকানদারি করতেন। তিনি একবার একা একটা গরু কোরবানি দিয়েছিলেন। সেটা বড় আলোচনার বিষয় ছিল। শুধু তা-ই নয়, তিনজনে মিলে কোরবানি দিলেও আমরা ধরে নিতাম তারা ধনী মানুষ। এখনকার দিনে কি আর এসব কিছু মেলে? এখন তো বাটোয়ারার গোস্ত আধা কেজি, এক কেজি দেয়। আমাদের সময়ে দেখতাম দুই কি তিন টুকরো করে বাটোয়ারার গোস্ত বিলি করতে। এখন আমি ঈদে গ্রামে, স্কুলের মাঠে, ইউনিয়ন কাউন্সিলে বেশ কয়েকটা গরু দিই নিয়মিত আনন্দ ভাগাভাগির উদ্দেশ্যে। 

আমার তো একবার মনে পড়ে স্বাধীনতার পরে সরকার সহায়তা হিসেবে কাপড় দিয়েছিল টেট্রন কাপড়। রাজনৈতিক নেতারা, ইউনিয়ন কাউন্সিলরের চেয়ারম্যানরা এসব ভাগ করে দিত। সেখানে আমাদের গ্রামে পড়েছিল চারটা বা পাঁচটা শার্টের কাপড়, যেগুলো নিয়ে আবার সেলাই করতে হতো। এটা না পেয়ে কত লোক গ্রামের মাতবরের কাছে গিয়ে অভিযোগের সুরে বলতেন—ছেলেটারে অনেক বছর নতুন শার্ট দিতে পারিনি। এসব মনে পড়লে এখনো কষ্ট লাগে। কারণ এসবের প্রতক্ষ্যদর্শী ছিলাম। 

এবার আমার নিজের কথাই বলি। একবার ঈদের সময় আমার বাবার নতুন কাপড় পাঠানোর কথা ছিল, কিন্তু পাঠাননি। তিনি পাঞ্জাবি কিনতে দুই বাজারে গিয়েও দামাদামি করে সুবিধা করতে না পারায় আর কেনেননি। আমি সেবার রাগ-আভিমান করে আর ঈদের জামাতেই যাইনি। 

তখনকার সময়ে আত্মীয়-স্বজন যা-ই পাকাত এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে স্বজনদের কাছে নিয়ে আসত। এটা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে-পরের সময়ের কথা বলছি। আমি যখন ’৭২ বা ’৭৩ সালের দিকে চাকরিতে ঢুকলাম সামর্থ্য অনুযায়ী বাড়িতে মা, চাচি, দাদির জন্য কাপড় নিয়ে যেতাম। সেটা যে কত দারুণ অনুভূতি। মনে আছে সে সময়েও আমি বিভিন্ন মহাজন থেকে জাকাতের কার্ড নিয়ে টাকা তুলে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় দিতাম। 

আমাদের শৈশবে যাদের সামর্থ্য ছিল তাদের মধ্যেই ঈদে সালামি কিছুটা প্রচলিত ছিল। পরিস্থিতি এমন ছিল যে কৃষক পরিবারগুলো তখন আট আনা, ১ টাকা নিয়ে বাজারে যেত। তবে যখন ক্লাস এইট-নাইনে পড়ি তখন প্রথম পরীক্ষার দিনে সালাম করতে গেলে এক আনা বা দুই আনা দিতেন মুরব্বিরা। এখন স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে আমার পরিবার। প্রিয়জনদের সান্নিধ্য যেন ঈদের আনন্দ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। আমি ছোটবেলায় সালামি না দেখলে কী হবে, আমার ছেলেমেয়েদের ঠিকই দিতে হয়েছে। তাও শুরুর দিকে দিতাম না। দেখা যেত আমার বাসায় কোনো স্বজন বা বন্ধুবান্ধব এলে আমার ছেলেমেয়েদের দিলে তারা আমাকে চাপ দিত—চাচ্চু দিয়েছে তুমি দেবে না কেন? এ প্রেশারে পড়েই ঈদে ছেলেমেয়েদের সালামি দেয়া শুরু করলাম। তবে এখন সন্তানরা বড় হয়েছে, এখন সালামি দিই নাতি-নাতনিদের। এতে আনন্দ পাই, ভালো লাগা কাজ করে। 

ঈদের আনন্দকে কাছের মানুষ এবং সমাজের দরিদ্র ও দুস্থ মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাই। চেষ্টা করি ঈদের ছুটিতে বাংলাদেশেই কাটাতে। বিদেশে মূলত ব্যবসায়িক মিটিং কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনীয়তা না থাকলে যাওয়ার জন্য মন টানে না। অর্থাৎ কয়েক দিন বন্ধ আছে তাই সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ঘুরে আসি; এমনটা কখনো আমার মানসিকতায় আসেনি। তবে ব্যবসায়িক আলোচনা ও চুক্তির বিষয় কিংবা কারখানা দেখতে হলে যাই।

কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামে নিজের জন্মস্থানে শিক্ষার জন্য যতটা সম্ভব চেষ্টা করছি। প্রতিষ্ঠা করেছি বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার জন্য কাজ করতে অবশ্য আমার প্রয়াত বাবার অনুপ্রেরণাও রয়েছে। কভিডের সময় থেকে শুরু করার পর ১০০-এরও বেশি উন্নত মানের ঘর তৈরি করে দিয়েছি। স্কুলের বৃত্তির জন্য জাকাতের টাকা পাঠিয়ে রাখি। আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে আমার মূল ফোকাস থাকে এমনভাবে সহযোগিতা করা, যেন সেই পরিবারের জন্য কর্মসংস্থান গড়ে ওঠে। দুই বছর আগে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলাম বাড়িঘর, সিএনজি, যারা বিদেশে যায় তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। যারা বিদেশে যায় তাদের মধ্যে দেখা যায় ইউরোপে গেলে ৮ লাখ, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে গেলে ৩-৭ লাখ টাকার মতো করে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। এভাবে অনেককেই বিদেশে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। আমার গ্রামকে দরিদ্রমুক্ত করার প্রোগ্রাম আছে। এজন্য কলেজের প্রিন্সিপালের নেতৃত্বে একটা টিমও তৈরি করে দিয়েছি। এরই মধ্যে আমার গ্রামে বর্তমানে ঘরবিহীন নেই কেউ। নিজের গ্রামসহ আশপাশের গ্রামে ধরন বুঝে কাউকে গাভী, কাউকে সিএনজি কিনে দিচ্ছি স্বাবলম্বী করে তুলতে। 

ব্যবসার পরিস্থিতি এমনও গেছে কয়েকশ কোটি টাকা লস হয়েছে। কিন্তু ইনক্রিমেন্ট নিশ্চিত করেছি। দূরে সচরাচর যেসব কারখানা-ডিপোয় যাওয়া হয় কম; যেমন ময়মনসিংহ, যশোর, বগুড়া প্রভৃতি এলাকায় তখন ঈদের বন্ধে ঘুরে আসি। এবারের ঈদে প্ল্যান আছে ময়মনসিংহের ভালুকায় যাওয়ার। সেখানে আমার ছোট দুটি ইউনিট আছে সেগুলো দেখতে যাব। এছাড়া ঢাকার আশপাশে টঙ্গী, সাভার প্রভৃতি এলাকায় যেসব ইউনিটে সচরাচর কম যাওয়া হয় সেগুলো দেখতে যাব। সত্যিকার অর্থে যদি বলি এতেই আমি মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পাই। অবসরে নতুন উদ্যোগ নিয়ে আরো বেশি ভাবনা কাজ করে। নতুন করে মানুষের কাজের ব্যবস্থা করতে পারলেই যে আনন্দ অনুভব করি সেটা বোঝানোও যাবে না। 

পরিশেষে বলি, ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। তাই বলি, শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক ঈদ আনন্দ। ঈদুল ফিতর আমাদের মধ্যে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ, সুখ ও শান্তি—এটাই আমার প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন