খাদ্যগুদাম সংস্কার প্রস্তাব

নতুন ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে ব্যয় ২৩০০ টাকা সংস্কারে ৪১০০

ইয়াহইয়া নকিব

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের খাদ্যগুদামগুলোর ধারণক্ষমতা ২১ লাখ টন। ২০২৫ সালের মধ্যে এ সক্ষমতা ৩৭ লাখ টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা সরকারের। দীর্ঘমেয়াদি এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পুরনো ৪২৪টি গুদাম সংস্কারের জন্য ৬৪৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরে একটি প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এতে প্রতি বর্গফুট ভবন সংস্কারে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ হাজার ১০০ টাকা। অথচ সরকারেরই বিভিন্ন প্রকল্পে নতুন ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে ব্যয় পড়ে ২ হাজার ৩০০ টাকার মতো। প্রকল্পটি নিয়ে তাই পরিকল্পনা কমিশন আপত্তি তোলায় ৫৩ শতাংশের বেশি ব্যয় কমছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। 

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রমতে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে খরা মৌসুমে খাদ্যশস্য সংরক্ষণ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন সরকারপ্রধান। একই সঙ্গে সরকারের খাদ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে খাদ্যপণ্যের মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তারই আলোকে ষাট কিংবা আশির দশকে নির্মাণ করা ৪২৪টি খাদ্যগুদাম সংস্কারে ৬৪৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটির বিষয়ে ফেব্রুয়ারির শুরুতে পরিকল্পনা কমিশনে মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়। সেখানেই অস্বাভাবিক ব্যয়ের বিষয়টি উঠে আসে।  

মূল্যায়ন কমিটির ওই বৈঠক সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটিতে গুদাম সংস্কার ও মেরামতের জন্য প্রতি বর্গমিটারের ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা। প্রতি বর্গফুটে এ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ১০০ টাকা। অথচ বিভিন্ন প্রকল্প প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও প্রতি বর্গমিটারে ব্যয় হয় ২৫ হাজার আর প্রতি বর্গফুটে ২ হাজার ৩০০ টাকার মতো। অর্থাৎ নতুন ভবন নির্মাণের চেয়ে সংস্কারের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে দ্বিগুণ। 

নির্মাণ খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাঝারি থেকে উচ্চ মানের বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও প্রতি বর্গফুটে ব্যয় হয় ২ হাজার ১০০ থেকে আড়াই হাজার টাকার মতো। মালপত্রের গুণগত পার্থক্যের কারণে তা কম বেশি হতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নরসিংদীর কুটির ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির প্রধান নির্বাহী শরীফ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মাঝারি মানের তিনতলা একটি ভবন নির্মাণে গড়ে প্রতি বর্গফুটে ব্যয় হয় ২ হাজার ১০০ টাকা। টাইলসের মানের ভিত্তিতে উচ্চ মানের ক্ষেত্রে এতে আড়াই-তিন হাজার টাকা ব্যয় হতে পারে। বর্গমিটার হিসেবে এ ব্যয় ৬ হাজার ৮০০ থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত পড়তে পারে।’

ঢাকায় বেসরকারি বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে বর্গফুটপ্রতি গড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা ব্যয় হয় বলে জানান দেশের শীর্ষ এক আবাসন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মালপত্রের গুণগত মানের ওপর ভিত্তি করে ব্যয়ের পার্থক্য হতে পারে। বড় আকারের ভবন নির্মাণে ব্যয় কম হয় এবং ছোট ভবনের ক্ষেত্রে তা বাড়তে পারে। তবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নির্মাণ ব্যয় অনেকটা একই থাকে। কারণ মজুরি ও নির্মাণসামগ্রীর দামে খুব একটা হেরফের হয় না।’ 

‘সারা দেশে অবস্থিত ক্ষতিগ্রস্ত খাদ্যগুদাম ও অন্যান্য স্থাপনার সংস্কার’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০২৪-২৭ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে চায় খাদ্য অধিদপ্তর। এতে গুদাম মেরামত বা সংস্কার বাবদ প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১১৮ কোটি টাকা। ৬১ হাজার ২৬৯ বর্গমিটারে অন্যান্য অবকাঠামো বা স্থাপনা মেরামত বাবদ ২৭৯ কোটি টাকা রাখা হয়। এছাড়া ড্রেন, রাস্তা, সীমানাপ্রাচীর ও টিউবওয়েল স্থাপনের জন্য ব্যয় ধরা হয় ২৩৪ কোটি টাকা। 

সরকারি এ প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় প্রাক্কলনের বিষয়ে প্রকল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন ঠিকাদার কাজ নিয়ে অন্যদের তা দিয়ে দেন। এভাবে কয়েকবার হাতবদলে কাজ হওয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হচ্ছে। ফলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এসব নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। 

এ বিষয়ে সাবেক সচিব ও প্রকল্প বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কয়েকজনের হাতবদল হয়ে একটি কন্ট্র্যাক্ট সম্পন্ন হয়। দেখা যায় কেউ একজন কাজ পাচ্ছে, কিন্তু সাব-কন্ট্র্যাক্ট দিয়ে দিচ্ছে অন্য কাউকে। এভাবে মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্য প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায়। দলীয় লোকজন খাদ্য বিভাগে টাকা দিয়ে হয়তো কাজটি নেবে। কিন্তু যে কাজ নেবে সে হয়তো কোনো কাজ করবে না। সমাজে এদের সংখ্যা বাড়ছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এসব ব্যয় নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।’ 

পরিকল্পনা কমিশনের মূল্যায়ন সভা সূত্রে জানা যায়, ৬৪৫ কোটি টাকার প্রকল্পটিকে কাটছাঁট করে ৩০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ফলে শতাংশের হিসাবে ব্যয় কমছে ৫৩ শতাংশেরও বেশি। সেই সঙ্গে প্রাথমিকভাবে ২৫০টি গুদাম সংস্কার করতে বলা হয়। অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় কমানোরও নির্দেশনা দেয়া হয় বৈঠকে। এছাড়া কোন গুদামগুলো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তা নির্ধারণে একটি সমীক্ষা করারও নির্দেশ দেয়া হয় খাদ্য অধিদপ্তরকে। 

এ বিষয়ে জানতে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে এক খুদে বার্তা পাঠিয়ে জানান, তিনি হাসপাতালে আছেন, তাই ফোন ধরতে পারছেন না।

পরে প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকা অধিদপ্তরের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিটের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে এসব নিয়ে তিনি ফোনে কথা বলতে রাজি হননি।

প্রকল্প ব্যয়ের সার্বিক বিষয়ে কথা হয় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। নজরদারির মাধ্যমে প্রকল্প ব্যয় সাশ্রয়ী না হওয়ায় অর্থনীতিতে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন এ বিশ্লেষক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে প্রতিবেশী দেশের চেয়ে, আগের প্রকল্পের চেয়ে, এমনকি বেসরকারি নির্মাণের চেয়ে বেশি ব্যয় হয়। এটি একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেনাকাটায় নিয়মনীতি মানা হয় না। অনলাইন ক্রয়পদ্ধতি করা হলেও অনেক ধরনের ব্যত্যয় হতে দেখা যায়। তাই সময়মতো ব্যয় সাশ্রয়ীভাবে প্রকল্পের কাজ করার জন্য জবাবদিহি ও নজরদারি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের মূল্যায়ন বিভাগের লোকবল বাড়িয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। সরকারি কম্পট্রোলার জেনারেলের অফিসের বিভিন্ন প্রতিবেদনও কেনাকাটার বিভিন্ন ব্যত্যয়ের বিষয়ে উল্লেখ থাকে। প্রকল্প ব্যয়ের বিষয়ে এখন সাশ্রয়ী না হলে তা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন