সময়টা ২০০০ সাল। তাকাশি মুরাকামি তখন যুক্তরাষ্ট্র সফরে। তিনি সেখানে একটা চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। সেখানে তিনি তার কাজকে সংজ্ঞায়িত করলেন ‘সুপারফ্ল্যাট’ নামে। পপুলার কালচারের সঙ্গে মিশেল ঘটান জাপানি পরিচয়কে। আধুনিকতার সঙ্গে একীভূত হয় ঐতিহ্যচেতনা। সেদিন ভিজুয়াল সংস্কৃতিকে পরিবর্তনে মুরাকামি যে নিজস্ব তত্ত্ব হাজির করেন, তাতে প্রভাবিত হয়ে পুরো একটা প্রজন্ম তৈরি হলো। তাদের মধ্যে আয়া তাকানো ও চিহো আওশিমা অন্যতম। তারা উভয়ই বৈশ্বিক পরিসরে ঠাঁই করে নিয়েছেন অনন্য চিত্রকর্মের মাধ্যম। বৈশ্বিক গতিবিধির প্রতিধ্বনি থাকার পরও তারা মূল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। যে কেউ তাদের চিত্রকর্মে তাকালে জাপানের চিরায়ত চিত্রকলার ধারার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবে।
সমকালীন জাপানি চিত্রকলার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যই বহুমাত্রিকতা। জাপানের জন্য চিত্রকলার ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। কিন্তু সমকালীন প্রবণতা প্রকাশ পায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মেইজি আমলে। সে সময় দেশটি পশ্চিমা দুনিয়ার জন্য দুয়ার খুলে দেয়। তার পর থেকে অর্ধশতকজুড়ে বৈশ্বিক চিত্রকলার নানা রীতিনীতি প্রভাব ফেলে গেছে দেশটিতে। তবে এ প্রবাহ একমুখী ছিল না। জাপানি চিত্রকররাও তাদের সৃজনশীলতার মাধ্যমে আকর্ষণ করতে থাকেন বহির্বিশ্বের দৃষ্টি। বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর টোকিও ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। সে সময় দেখা দিতে শুরু করে গুতাই গ্রুপ, হি রেড সেন্টার ও মোনো-হার মতো হরেক কিসিমের শিল্প আন্দোলন। এসব শিল্প আন্দোলন সংস্কৃতি, রাজনীতি ও প্রাত্যহিক জীবনের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। ক্রমে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে যাপিত জীবনে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আধুনিকতার সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতির ফিউশন ছিল অন্য মাত্রার। মূলত এ সময়েই পশ্চিমা কনসেপচুয়াল পেইন্টিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় জেন বৌদ্ধধর্মের মতো জাপানি দর্শনের নানা অনুষঙ্গ।
সমকালীন জাপানি চিত্রকলায় সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত নাম ইয়ায়োই কুসামা ও তাকাশি মুরাকামি। বিশ্বব্যাপী প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে তাদের কাজ। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন ইয়োকো ওনো, ইয়োশিতোমো নারা ও নবুইয়োশি আরাকি। আশির দশকেই জাপান এক অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। সে সুযোগে সমকালীন চিত্রকলার সঙ্গে সংযোগ ঘটতে থাকে ফটোগ্রাফি, সংগীত, অ্যানিমে, ফ্যাশন, ডিজাইন ও প্রযুক্তি। এক্ষেত্রে নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসতে থাকে নতুন নতুন ভাবধারা নিয়ে। তারা ফাইন আর্টের সঙ্গে পপ কালচারের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। এ ঘরানায় সম্ভবত প্রাগ্রসর নাম ইয়োশিতোমো নারা। তার কার্যক্রম প্রভাবিত ছিল মঙ্গা কমিক দিয়ে। এদিকে চিত্রকর মারিকো মোরি সায়েন্স ফিকশনকে মিশ্রিত করেছেন আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে। রায়োজি ইকেদা ইলেকট্রনিক মিউজিক ও ভিডিওতে শিল্পের ব্যবহার ও প্রয়োগ তুলে ধরেছেন। কোহেই নাওয়াও একজন বহুমাত্রিক চিত্রশিল্পী। তিনি হরিণ, নেকড়ে, বাঘ আঁকেন জটিল কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে। সিহারু শিয়োতা করেন ইনস্টলেশন, যার খ্যাতি এর মধ্যেই ইউরোপে ছড়িয়ে গেছে।
২০১৭ সালে বৈশ্বিকভাবে পরিচিত টিমল্যাব তোকিয়া পার্কের সারা বনভূমিকে শিল্পচর্চার মাধ্যমে পরিণত করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। পেছনে ঐতিহ্যগত কারণ ছিল অবশ্য। প্রাচীনকাল থেকেই জাপানে সংস্কৃতিতে প্রকৃতিকে দেখা ও অনুধাবনের জন্য বিশেষ চর্চা চালু আছে। তারই ধারাবাহিকতা ছিল এটি। ১৯৫৬ সালে গুটাই গ্রুপ আশিয়া জঙ্গলে শিল্পকলা প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। তাদের মধ্য দিয়ে সমকালীন চিত্রকলায় যেন নতুন যুগের পত্তন হলো। প্রযুক্তির যুগে এসে খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে জাপানের পরিস্থিতি। তার প্রভাব পড়ছে সেখানকার সৃষ্টিশীল কাজে, বিশেষ করে সেখানকার ঐতিহ্য নিয়ে বোঝাপড়ায়। তবে তারা ঠিক যেমনটা শেকড়সচেতন, অমন শেকড়সচেতন শিল্পী সহজে পথ ভুল করেন না।