হাইপোগ্লাইসেমিয়া হাইপারগ্লাইসেমিয়া

হাইপোগ্লাইসেমিয়া ও হাইপারগ্লাইসেমিয়া প্রতিরোধে করণীয়

অধ্যাপক ডা. সমীরণ কুমার সাহা, ছবি: হেলথলাইনডটকম

মানবদেহে শক্তির প্রধান উৎস শর্করা বা গ্লুকোজ। শর্করা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় দেহে সঞ্চিত থেকে শক্তি উৎপাদনের কাজ করে। কোনো কারণে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত কমে গেলে তাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া আর শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক বেড়ে গেলে তাকে হাইপারগ্লাইসেমিয়া বলে। উভয়টিই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। নিয়মিত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মাধ্যমে এ ধরনের জটিলতামুক্ত থেকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব।

হাইপোগ্লাইসেমিয়া

রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা হঠাৎ অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়াকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলে। হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৩.৫ মিলিমোল/লিটারের নিচে নেমে যায়। যদি তৎক্ষণাৎ গ্লুকোজ গ্রহণ করা না হয় তাহলে মস্তিষ্কে শর্করা কমে গিয়ে রোগী অচেতন হয়ে পড়ে, কখনো খিঁচুনি শুরু হয়। অনেক সময় ঘুমের মধ্যেই রক্তে শর্করা কমে যেতে পারে, যা বিপজ্জনক। 

কী কী কারণে হতে পারে হাইপোগ্লাইসেমিয়া 

হাইপোগ্লাইসেমিয়ার নানাবিধ কারণের মধ্যে রয়েছে—  

 সময়মতো খাবার না খাওয়া

 পরিমাণে খুব কম খাওয়া 

 ইনসুলিন গ্রহণের পর খেতে ভুলে যাওয়া

 সঠিক মাত্রায় ইনসুলিন ও সালফোনাইল ইউরিয়া গ্রহণ না    করা

 অতিরিক্ত ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রম করা

 মদপান করা

 দীর্ঘস্থায়ী পেটের পীড়া বা ডায়রিয়াজনিত রোগে ভোগা

এছাড়া যেসব রোগীর লিভার ও কিডনির সমস্যা রয়েছে এবং ক্ষুধামান্দ্যে ভুগছে কিন্তু ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ইনসুলিনসহ অনেক ওষুধ একসঙ্গে ব্যবহার করছে তাদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে।

হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ 

 অতিরিক্ত খিদে পাওয়া

 শরীরে ঘাম হওয়া

 বুক ধড়ফড় করা

 অল্পতেই রেগে যাওয়া

 দেহে কাঁপুনি অনুভব করা

 অস্থির লাগা

 কোনো কাজে মনোযোগ দিতে না পারা

 মাথা ব্যথা ও বমি বমি ভাব 

 চোখে ঝাপসা দেখা 

চিকিৎসা

হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে রোগীর অবস্থার ওপর ভিত্তি করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা ব্যবস্থা নিতে হবে। জ্ঞান হারায়নি এবং মুখে খেতে পারছে এ ধরনের রোগীদের ১০-১৫ গ্রাম গ্লুকোজের পানি, গ্লুকোজের বড়ি অথবা চিনি বা গুড়ের শরবত খাওয়াতে হবে। রোগী অচেতন হয়ে পড়লে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। রোগীর মাংসপেশিতে ১ মিলিগ্রাম গ্লুকাগন দিতে হবে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে গ্লুকাগনের মাত্রা হবে ০.৫ মিলিগ্রাম। অচেতন বা অর্ধচেতন বেশির ভাগ রোগীই ১ ঘণ্টার মধ্যে চেতনা ফিরে পায় এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যায়।

প্রতিরোধ

হাইপোগ্লাইসেমিয়া প্রতিরোধের প্রধান উপায় হলো সচেতনতা। এজন্য ডায়াবেটিসের রোগীকে—

  নিয়মিত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করাতে হবে 

  সময়মতো খাবার খেতে হবে 

  কোথাও ভ্রমণের সময় ইনসুলিন ও অন্যান্য ওষুধের পাশাপাশি গ্লুকোজ, মধু, হালকা মিষ্টি বিস্কুট সঙ্গে রাখতে হবে 

  প্রতি চার মাস পর পর রক্তে হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করাতে হবে

  ইনসুলিন গ্রহণের পর খালি পেটে থাকা যাবে না। হালকা কিছু হলেও খেতে হবে 

হাইপারগ্লাইসেমিয়া 

হাইপোগ্লাইসেমিয়ার বিপরীত প্রক্রিয়া হলো হাইপারগ্লাইসেমিয়া। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা যখন স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেড়ে যায় তখন হাইপারগ্লাইসেমিয়ার মতো জটিলতা সৃষ্টি হয়। হাইপারগ্লাইসেমিয়া হলে রক্তে শর্করার পরিমাণ ১১.১ মিলিমোল/লিটারের বেশি হয়।

কারণ

দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছে কিন্তু সঠিক চিকিৎসা নিচ্ছে না এমন ব্যক্তিদের রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বেড়ে গিয়ে হাইপারগ্লাইসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া—

  মানসিক চাপ

  কোনো অসুস্থতা বা সংক্রমণ

  স্টেরয়েড বা ইমিউনোসপ্রেসেন্টস জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করা

  পর্যাপ্ত ইনসুলিন বা অন্যান্য ডায়াবেটিসের ওষুধ সঠিকভাবে ব্যবহার না করা

  নিয়ম মেনে খাবার না খাওয়া

  প্রয়োজনের অতিরিক্ত হাইপোগ্লাইসেমিয়ার চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া। 

এসব কারণেও হাইপারগ্লাইসেমিয়া হয়। 

উপসর্গ

রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে গেলে—

 ঘন ঘন প্রস্রাব হয়

 ক্লান্ত লাগে

 ওজন কমে যায়

 দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে

 শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়

 মাথা ব্যথা ও বমি বমি ভাব হয়

 পেট ব্যথা হয়

 দেহে পানিশূন্যতা দেখা দেয় 

জটিলতা

হাইপারগ্লাইসেমিয়া নিয়ন্ত্রণে না আনলে হৃৎপিণ্ড, স্নায়ু, কিডনি, চোখের রেটিনার রক্তনালির রোগসহ হাড় ও জয়েন্টে সমস্যা, দাঁত ও মাড়ির সংক্রমণজনিত দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা দেখা দিতে পারে। 

হাইপারগ্লাইসেমিয়া প্রতিরোধে করণীয়

হাইপারগ্লাইসেমিয়া প্রতিরোধে—

 যেসব খাবার খেলে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায় সেসব খাবার এড়িয়ে চলুন।

 নিয়মিত ব্যায়াম করুন।

 মানসিক চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। 

 চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাত্রায় ইনসুলিন গ্রহণ করুন। 

 গ্লুকোমিটারের সাহায্যে নিয়মিত রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করুন।


লেখক: অনারারি প্রফেসর, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

সিনিয়র কনসালট্যান্ট, মেডিসিন বিভাগ, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল          

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন