প্রদর্শনীতে কলাকেন্দ্রের খোঁজখবর

ওয়াহিদ সুজন

২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত কলাকেন্দ্র ৮৫টি একক ও যৌথ প্রদর্শনী করেছে ছবি: মাসফিকুর সোহান

এমন একটা গড় ধারণা দেয়া যায় যে প্রবহমানতা হলো সৃজনশীলতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাঁধাধরা নিয়ম বা অভ্যস্ততার বাইরে তার নিজস্ব গতি রয়েছে। এমন নয় যে বাস্তবতাবহির্ভূত কোনো যাপনের চিহ্ন ধারণ করে সাহিত্য, শিল্প বা আর যা কিছু আছে। বরং তার ভেতরকার নির্যাসটুকু আরো স্পষ্ট করে ধরা দেয়। ফলত চিত্রশিল্প বা সমসাময়িক শিল্পকর্ম আর প্রবহমান জীবন আলাদা থাকে না, সময়ের চিহ্নগুলো তাতে স্পষ্টভাবে উঠে আসে। এ এক অনির্ধারিত ভঙ্গি, যা সময়ের নিরিখে তার নির্দিষ্টতাকে জানিয়ে দেয়। এর জন্য তো চিহ্ন দরকার পড়ে, যেমন প্রদর্শনীর ক্যাটালগ বা পোর্টফোলিও। সেটাই লেখার উদ্দেশ্য। সম্প্রতি তেমন একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে লালমাটিয়ার কলাকেন্দ্র। এ প্রদর্শনীর আগ্রহের জায়গা হলো খোদ গ্যালারি নিজেই শিল্পসত্তা, নিজেই দেখার বিষয়।

এ আয়োজনের শিরোনাম ‘কলাকেন্দ্রের প্রকাশনা প্রদর্শনী’। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এ আর্ট গ্যালারি এরই মধ্যে ৮৫টি একক ও যৌথ প্রদর্শনী করেছে। এছাড়া শিল্প নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন তো আছে। তো, এ প্রদর্শনীতে ছিল সেসব এক্সিবিশনের ক্যাটালগ, সঙ্গে কলাকেন্দ্র প্রকাশিত বই, মনোগ্রাফ ও ৯৫টি শিল্প বিষয়ে বক্তৃতা, আলোচনা, শিল্পীকথন, প্রদর্শনীর ওপর তথ্যচিত্র, পারফরম্যান্স ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের ভিডিওচিত্র। সব মিলিয়ে দেখা-শোনা এবং বোধকরি উপলব্ধির সপ্তাহব্যাপী এক মজমা। এ উপলক্ষে কলাকেন্দ্রকে সচরাচর যেভাবে দেখা যায়, সেই পরিচিত পরিসর খানিকটা অন্যভাবেই দেখা গেল।

প্রদর্শনীর লক্ষ্য সম্পর্কে কলাকেন্দ্র বলছে, ‘বাংলাদেশের সমসাময়িক শিল্পবিষয়ক প্রকাশনার পরিকল্পনা, নান্দনিকতা, সৃজনশীলতা, নকশা, উপস্থাপনা ও যোগাযোগের মাধ্যম পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশনার মাস ফেব্রুয়ারির শেষে “‍কলাকেন্দ্রের প্রকাশনা প্রদর্শনী” নিজেদের ও দর্শকদের মতামতে বিচার-বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে উপস্থাপন।’

এর মাধ্যমে একধরনের খতিয়ান তুলে ধরেছে কলাকেন্দ্র। আগামীতে এর বিস্তৃতি ঘটাতে চায় তারা। এ প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, ‘সারা দেশের শিল্পবিষয়ক প্রকাশনা নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী আয়োজনের প্রস্তুতি হিসেবেও এ প্রদর্শনীকে দেখা হচ্ছে।’ এ হিসেবে নথিভুক্তকরণের অপ্রকাশ্য ধারাটি প্রকাশ্যে আসতে পারে।

গ্যালারি ঘুরে দেখা যায়, সময়ক্রম অনুসারে দেয়ালজুড়ে ঝোলানো হয়েছে প্রদর্শনীর ক্যাটালগ। শুরুতেই রয়েছে মুন রহমানের ‘ফাজি ফেয়ার’ বা ‘অজানা ভয়’ শিরোনামের প্রদর্শনীর ক্যাটালগ। ২০১৫ সালের মে মাসে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলে পরের মাস পর্যন্ত। এটি শুধু কলাকেন্দ্রের প্রথম প্রদর্শনী নয়, একই সঙ্গে শিল্পী মুন রহমানের প্রথম একক প্রদর্শনী। এরপর সময়ের পরিক্রমায় কলাকেন্দ্রের প্রদর্শনীতে মুন রহমানের আবারো অংশ রয়েছে। তবে প্রথম শব্দটির গুরুত্ব তো আলাদাই। নতুন পরিচিতি ও নতুন সম্ভাবনার আহ্বান থাকে। কলাকেন্দ্রের ঠিকুজি ঘাঁটলে দেখা যায়, অনেক তরুণ শিল্পীর প্রথম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে এখানে। আবার অনেক সিনিয়র শিল্পীর কাজ অংশ হয়েছে বিভিন্ন আয়োজনের। ছিল যৌথ আয়োজন। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে এ গ্যালারি অনুষ্ঠিত হয়েছে সালমা জাকিয়া বৃষ্টি ও তার সন্তান মাশরাফি আভিনের ‘দ্বৈবিধ্য—মা ও সন্তান, অবিচ্ছেদ্য সংযোজন’ শিরোনামের ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী। এছাড়া জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান বা মোহাম্মদ কিবরিয়ার কাজ নিয়ে করা প্রদর্শনীর ক্যাটালগও স্থান পেয়েছে এতে। অর্থাৎ নতুন-পুরনো বা বহমানতার প্রদর্শনমূলক ধারা বজায় রেখেছে কলাকেন্দ্র। এ প্রদর্শনী না হলেও তা-ই কী করে জানত হালের দর্শক।

‘কলাকেন্দ্রের প্রকাশনা প্রদর্শনী’ শীর্ষক আয়োজন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কলাকেন্দ্রের অর্জনও তুলে ধরে। একটি গ্যালারি একটি শহর বা জনগোষ্ঠীর বিশেষায়িত অংশের নন্দন ভাবনা ও আদান-প্রদানের প্রতিনিধিত্ব করে, যা শিল্প ও দর্শকের মিথস্ক্রিয়ার চিহ্ন। 

শিল্প একান্ত ব্যক্তিনিষ্ঠ হলেও সময়ের সঙ্গে এর যে প্রভাব তার একটা খতিয়ানও পাওয়া যায়। কলাকেন্দ্রের প্রদর্শনী ঘুরে দেখলে মাধ্যমগত একটি বিবর্তন ধরাও পড়ে। শুরুর দিকে তাকালে দেখা যায়, আর্টের কোনো একক ফর্ম বা মিডিয়াম ধরে এগিয়েছেন শিল্পীরা, ব্যতিক্রম ছিল না এমন না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বা কলাকেন্দ্রের সাম্প্রতিক বছরগুলোর এক্সিবিশন থেকে টের পাওয়া যায়, শিল্পীরা একটি মাধ্যমে আর সন্তুষ্ট নন। পেইন্টিংয়ের পাশাপাশি স্থাপত্য থেকে ভিডিওসহ নানা ফর্মে তারা নিজেদের ভাবনা উপস্থাপন করছেন। বিশেষ করে ইনস্টলেশনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা আগের চেয়ে যেন বেড়েছে। সাম্প্রতিক আয়োজনগুলোয় বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা ব্যাপক আকারে এসেছে। বাস্তবতা থেকে আড়াল হওয়ার চেষ্টাও আছে।

২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল; নয় বছরের এ যাত্রার একটি ছেদবিন্দু করোনা মহামারী; যার অভিঘাতও বিচ্ছিন্নতা, বিপন্নতা বা নিঃসঙ্গতা চিত্রায়ণে প্রভাব রাখতে পারে। কারণ কভিড-১৯-এর আগে-পরের দুনিয়ায় যে বদল তা কলাকেন্দ্রের পরপর অনেক প্রদর্শনী বা আয়োজনে উঠে এসেছে। 

আরেকটা বিষয় হলো আর্কাইভিংয়ের ধারণা। প্রদর্শনী শুরু ও শেষ হওয়ার চক্রের মধ্যে থাকে। এখানে তো শেষ হয়ে যায় না। একটা ক্যাটালগকে সাধারণত পরিচিতি হিসেবে দেখানো হয়। সংক্ষিপ্তসার থাকে। গুরুত্বপূর্ণ শিল্পভাবনাও থাকে। প্রদর্শনকাল আর পরবর্তী সময় কিন্তু আলাদা বিষয়। প্রদর্শনীর মতো জীবন্ত ঘটনার মধ্যে ক্যাটালগ হয়তো খুব বেশি আলাদা অর্থ বহন করে না বা মনোযোগ নাও পেতে পারে। কিন্তু শিল্পভুবনে এই যে দাগ (ইতিবাচক অর্থ) তা আসলে কোথায় রক্ষিত হয়। এখানে ক্যাটালগের একটা গুরুত্ব আছে। গুরুত্ব আছে এর গুছিয়ে রাখারও। পরম্পরা যদি গুছিয়ে দেখানো না যায়, তবে ভবিষ্যৎও হয় অগোছালো। এভাবে যদি আমরা আরো আরো গ্যালারির তত্ত্ব-তালাশের মধ্যে থাকি, তাহলে একটি শহর বা দেশের দৃশ্যশিল্প নিয়ে সামগ্রিকভাবে দেখার সুযোগ থাকে। কলাকেন্দ্রের এ আয়োজনের তাৎপর্য রয়েছে এদিক থেকে। তাদের পরিকল্পনা অনুসারে অন্য আর্ট গ্যালারিগুলোও যদি এগিয়ে আসে, তবে তো কথাই নেই!

প্রদর্শনীতে বেশকিছু বই স্থান পেয়েছে। সংখ্যায় খুবই কম। মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। এটাও তো একধরনের আর্কাইভিং। আবার ভিডিও ডকুমেন্টেশনের উপস্থাপন দেখা যায়; যা ডিজিটাল সময়ের চাহিদার নিরিখে তৈরি। তবে এ বিষয়ে আরেকটু গোছানো কাজ করার সুযোগ আছে। যেমন ফেসবুক লাইভে ‘কলাকেন্দ্রের প্রকাশনা প্রদর্শনী’ বিষয়ে আলোচনার অনেকটাই বোধগম্য হয় না কারিগরি কারণে। এটা ছোট উদাহরণমাত্র। অন্যদিকে আমাদের আর্ট গ্যালারি বা শিল্পের আর্থিক সীমাবদ্ধতা সবারই কম-বেশি জানা। এ কারণে অনেক সময় নামমাত্র ক্যাটালগ তৈরিও কঠিন হয়ে পড়ে।  সে সক্ষমতা কলাকেন্দ্র জারি রেখেছে; এটা সাধুবাদের বিষয়। একই সঙ্গে কলাকেন্দ্রের ওয়েবসাইটে ক্যাটালগগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে, যার আরো পরিমার্জন ঘটতে পারে। সময়ের পাশাপাশি বিষয়, মিডিয়াম, ফর্ম নানা সাব-ক্যাটাগরিতে ভাগাভাগি করে দেখার সুযোগও রাখা যেতে পারে। মোটের ওপর এমন তত্ত্ব-তালাশ আমাদের শিল্পভুবনকে আরো সমৃদ্ধ করবে; এ প্রত্যাশা বোধহয় ভুল নয়। এমন দারুণ বিষয়গুলো বারবার ঘটুক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন