ক্যানভাসে বসন্তের রঙ

উদ্যানে বসন্ত। শিল্পী: সুমন ওয়াহিদ

বসন্তের হাওয়া যবে অরণ্য মাতায় 

নৃত্য উঠে পাতায় পাতায়, 

এই নৃত্যে সুন্দরকে অৰ্ঘ্য দেয় তার, 

‘ধন্য তুমি’ বলে বার বার।


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাকে সত্য করেই নতুন করে সাজছে প্রকৃতি। শীতকে বিদায় জানিয়ে নিজস্ব উষ্ণতায় প্রাণ সঞ্চার করছে বসন্ত। বসন্ত ঋতু লুকিয়ে আছে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসের ভেতর। প্রকৃতি এ সময় খুলে বসে রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ আর সৌন্দর্যের ডালি। শিল্পীর ক্যানভাস তো প্রকৃতির দর্পণ। অভূতপূর্ব সুন্দরের জয়যাত্রায় তাদের তুলি নীরব থাকে না। বাংলার বসন্ত নিয়ে চিত্রশিল্পীদের অনুরণনকে কেন্দ্র করেই নভেরার আজকের আয়োজন। 

সুমন ওয়াহিদ 
সুমন ওয়াহিদের বেশির ভাগ ছবিই আঁকা হয় অ্যাক্রিলিক রঙ ব্যবহার করে। বসন্ত নিয়ে তার সৃষ্টিকর্মের অধিকাংশই জলরঙ কিংবা তৈলচিত্র। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে বসন্তকে মনে হয় শিল্পীদের ছবি আঁকার জন্য বেশ ভালো একটি সময়। অনেক ধরনের রঙ নিয়ে কাজ করা যায়। আমি বসন্তে যে কয়টি ছবি এঁকেছি, বেশির ভাগই জলরঙের ওপর।’ বসন্তের আঁকিবুঁকি নিয়ে পুরনো দিনের কথা স্মৃতিচারণ করেন তিনি। তার ভাষায়, ‘বসন্ত নিয়ে তৈলচিত্র আছে আমার, যা আমার ভীষণ পছন্দের। ছবিটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে আঁকা। সম্ভবত তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে পড়ি। ২০০৭ সালের কথা। উদ্যান তখন আরো সবুজ ছিল।’ 
সুমন ওয়াহিদের কাছে বসন্তে ছবি আঁকার মজা প্রকৃতিতে ফুটে ওঠা রঙের মধ্যে। যদিও প্রায়ই এটা শিল্পীর ওপর নির্ভর করে। অনেকেই শুধু রঙ নিয়ে কাজ করেন। অনেকে বসন্তের ফুল আবার কেউ কেউ পুরো প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন। তবে বসন্ত নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে তিনি একটি চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘অনেকগুলো রঙ নিয়ে কাজ করতে গেলে কালার কম্পজিশন নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়। কারণ বসন্তের যে রঙিন বিষয়টি তা ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে আবার গাঢ় রঙগুলো বেশি ব্যবহার করা যাবে না। তাহলে ছবিতে সে রঙের বিশেষত্বই থাকবে না। তবে আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে যদি বলতে চাই তাহলে আমার মনে হয় শিক্ষার্থীদের জন্য সময়টিকে নিয়ে কাজ করা খুব আনন্দের। এক্সপেরিমেন্ট করা যায় যেকোনো রঙ নিয়ে। প্রকৃতির নতুন একটি রূপ নিয়ে ছবি আঁকা যায়। আমিও এভাবে অনেক ছবি এঁকেছি।’
শাহনূর মামুন 
ঋতু বৈচিত্র্যে আউটডোরে গিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন শাহনুর মামুন। এই তো দুদিন আগেই গিয়েছিলেন কেরানীগঞ্জে। প্রতিটি কাজের পেছনেই শিল্পীর মনে কিছু ভাবনা থাকে। ছবির বিষয়বস্তু এবং অন্তর্নিহিত রূপ কেমন হবে এ বিষয়গুলো ভাবায়। সেদিকে ইঙ্গিত করে মামুন বলেন, ‘আমি এ বছর বসন্তের যে কাজটি করেছি, তা আমাকে একটি উপলব্ধি তৈরি করেছে। মানুষ আসলে ফুল। আমি যে সময়টিতে পৌঁছেছিলাম সূর্যমুখী বাগানে, মনে হয়েছে আর কিছু সময় আগে পৌঁছে যেতে পারলে বেশ ভালো হতো। কারণ ফুলগুলো তখন সূর্যের বিপরীতে কিছুটা ঝুঁকে গেছে। খুব বেশি সময় নেই এ ফুলগুলোর ঝরে পড়ার। তবে ঝরে পড়ার বেশি সময় না থাকলেও ফুলের মধ্যে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য রয়েছে। ঠিক যেমন আমাদের মধ্যবয়সী মানুষের মধ্যে আছে। মধ্যবয়স আমাদের একটি পরিপক্বতা বা পরিপূর্ণতায় নিয়ে আসে। শিল্পী হিসেবে আমার এ উপলব্ধি থেকে আমি ছবিটির নাম দিয়েছি ‍দ্য বিউটি অব মিডল এজ।’ ছবির মাধ্যমে শিল্পীরা বিভিন্ন কাব্যিক বিষয় খুব সহজে তুলে ধরতে পারেন। আর বসন্তকে ঘিরে যে কাজগুলো হয় সেখানে রঙ নিয়ে অনেক ধরনের কাজ করার সুযোগ থাকে। মামুনের এমন একটি কাজ হলো ‘দ্য সানরাইজ’। বসন্তের যে ফুলগুলো আমাদের কাছে পরিচিত তার চেয়েও বেশি অপরিচিত ফুল ফোটে বনে-পাহাড়ে। মামুনের ভাষায় সে রকম বনফুল নিয়েই আঁকা ছবি এটি।
মানিক বণিক
মানিক বণিক সাধারণত ল্যান্ডস্কেপ আঁকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। স্বাভাবিকভাবেই বসন্তকে ঘিরেও তার বেশকিছু সৃষ্টিকর্ম আছে। যদিও সবসময় আউটডোরে বসেই আঁকা হয়, এমন নয়। তিনি বলেন, ‘আমি ঘুরে ঘুরে প্রকৃতিকে উপভোগ করি। আমার গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার মনপুরায়। গ্রামের প্রকৃতি এমনিতেই চোখে লেগে থাকে। আমি কখনো বসে থাকি আমাদের খোলা মাঠে। সেখানের কত রকমের দৃশ্য। আবার মাঠ পেরিয়ে গেলেই আমাদের গড়াই নদী। সেখানে আবার নদীর কিছু দৃশ্য। স্টুডিওতে এসে সেসব দৃশ্যকে নিজের মতো করে ভেবে আমার ছবি আঁকা হয়।’ স্বীয় চোখে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্মের একটি ‘গড়াই নদীর পাড়ে’। নদীর পাড়ে শিমুল ফুলের ছবিটি তিনি এঁকেছেন ২০২৩ সালের বসন্তে। এছাড়া শিল্পী মানিকের আউটডোরে বসে আঁকা অনেক ছবির মধ্যে ‘মনপুরায় বসন্ত’ অন্যতম। এছাড়া ঋতু বসন্ত নিয়ে ল্যান্ডস্কেপ শিল্পী মানিক বণিকের রয়েছে বেশকিছু ছবি। সূর্যমুখী, জারুল, সোনালু ফুল গ্রামের মেঠো পথ নামে এমন অনেকগুলো ছবি রয়েছে তার অঙ্কিত। এ সময়ের আবহাওয়া, ফুল-প্রকৃতি সব মিলিয়ে প্রতিটি ছবি বেশ রঙিন হয়ে থাকে। শিল্পী মানিক বসন্তে তার আঁকা বেশ পুরনো একটি ছবি পাঠিয়েছেন। ছবিটি ২০১৪ সালের এক বসন্তের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে বসে তিনি এঁকেছেন। বছর খানেক আগেও কৃষ্ণচূড়া গাছে জায়গাটি ছেয়ে ছিল।
কামরুজ্জোহা 
চিত্রশিল্পী হিসেবে কামরুজ্জোহা বেশি পছন্দ করেন ল্যান্ডস্কেপ আঁকতে। তার ভাষায়, ‘দেশের প্রকৃতিকে ঘিরে আঁকা ছবির সৌন্দর্য আলাদা রকমের হয়। স্বাভাবিকভাবেই সবাই রঙিন চিত্র আঁকতে পছন্দ করে, গাছের নতুন পাতা, ফল-ফুল সবকিছু মিলিয়ে প্রকৃতির নতুন একটি পরিবর্তন আসে। ভালোলাগা কাজ করে এ বিষয়গুলো শিল্পী মনকে আকৃষ্ট করে। আমার মনে হয় রঙ মানুষের মনকে উচ্ছ্বসিত করে তোলে। মানুষ রঙের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। সেজন্যই আমাদের বসন্তকে নিয়ে এক আলাদা আয়োজন।’ 
বসন্তকে নিয়ে তার আঁকা ছবিগুলোর বেশির ভাগই আউটডোরে বসে করা হয়েছে। তিনি প্রকৃতির মধ্যে থেকে কাজ করতে পছন্দ করেন। তবে সিলেটের চা বাগানে একটি পুকুরপাড়ে বসে একটি ছবি এঁকেছিলেন, যেখানে গাছের পাতাগুলোর ঝরে পড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে প্রকৃতির পরিবর্তন বোঝা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এখন আর আমাদের দেশে ঋতু পরিবর্তন চোখে পড়ে না সেভাবে। এত দ্রুত আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে এটি আসলে প্রকৃতিকে আমাদের অবহেলা থেকে প্রাপ্য।’

শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলেছেন ফারিহা আজমিন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন