নাম জুন পাইক: ভিডিও চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ

আলম খোরশেদ

নাম জুন পাইক ছবি: গুগেনহাইম মিউজিয়াম

নিরীক্ষার নগরী নিউইয়র্ক। কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে কত বিচিত্র নিরীক্ষাই না ঘটে চলেছে এ নগরীতে নিরন্তর। চিত্রকলা, সংগীত, নৃত্য, নাটক ও চলচ্চিত্র; কোনো মাধ্যমেই কমতি নেই সৃষ্টিশীল পরীক্ষা-নিরীক্ষার। মার্কিন শিল্পীদের এ এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য, কেবলই নতুন কিছু করা চাই। এ নেশায় যে সবসময়ই মূল্যবান ও মহৎ কিছু তৈরি হচ্ছে তা নয়, তবু এরই মধ্য থেকে মাঝে মধ্যে সত্যি সত্যি আনকোরা ও অভিনব কিছুর উদ্ভব হয় বৈকি। আর নতুনত্বের নিজস্ব যে স্বাদ সেটার মূল্যইবা কম কী? আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে তেমনই এক নতুন নিরীক্ষার দেখা পেয়েছিলাম নিউইয়র্কের অফ ব্রডওয়ের এক ব্যতিক্রমী প্রদর্শনশালা The Kitchen-এ। একদা সোহোর শিল্পপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত, বর্তমানে হাডসন নদীর পাড় ঘেঁষা এ আভাঁগার্দ শিল্প কেন্দ্রে অনেক তাবড় তাবড় শিল্পীই অনুষ্ঠান করেছেন। তাদের মধ্যে জন কেইজ, ফিলিপ গ্লাস, মার্স কানিংহাম, রবার্ট উইলসন, মেরিডিথ মঙ্ক প্রমুখ অন্যতম। Kitchen-এর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য, তারা ভিডিও প্রযুক্তিকে এ যুগের অন্যতম শিল্পমাধ্যম হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে এবং গোড়া থেকেই তার প্রচার, প্রসারে উদ্যোগীর ভূমিকা পালন করে এসেছে। সে যাক, তাদের সেই উপস্থাপনাটি ছিল ভিডিও আর্টেরই অন্যতম প্রধান পুরোহিত নাম জুন পাইক (১৯৩২-২০০৬) ও তার সাম্প্রতিক কিছু কাজকে নিয়ে। অনুষ্ঠানটির উপলক্ষ ছিল পোস্টমডার্ন মিউজিক ও কোরিওগ্রাফির প্রধান প্রবক্তা জন কেইজের (১৯১২-৯২) প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন।

অনুষ্ঠান সম্পর্কে কিছু বলার আগে এর প্রধান কুশীলব নাম জুন পাইক সম্পর্কে দু-চার কথা বলা জরুরি মনে করছি। জাতে কোরীয় নাম জুন পাইক মূলত একজন সংগীতশিল্পী। যৌবনে জার্মানিতে যান সংগীতের শিক্ষা নিতেই। সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় জন কেইজের। জন তার মধ্যে এক ব্যতিক্রমী, বিদ্রোহী শিল্পীসত্তার পরিচয় পেয়ে তাকে তার সঙ্গী করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসেন। তার পর থেকে শুরু হয় তাদের দুজনের যৌথ শিল্পসাধনা। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে মার্কিন সংগীত, নৃত্য ও চিত্রকলার অভিনব এক রূপান্তরের মধ্যে। ইতোমধ্যে নাম জুন পাইক তাঁর সংগীত ও চিত্রকলার দক্ষতাকে কাজে লাগাতে চাইলেন ভিডিওপ্রযুক্তির অঙ্গনে এবং এভাবে ক্রমান্বয়ে এমন এক শিল্পরূপের উদ্ভব হলো তার হাতে, যা এক কথায় মৌলিক ও অভিনব। স্বভাবত প্রযুক্তিপ্রিয় মার্কিন জনগণও তা লুফে নিল নির্দ্বিধায় এবং নাম জুন পাইক হয়ে দাঁড়ালেন তরুণ পোস্টমডার্ন শিল্পীগোষ্ঠীর একজন অলিখিত গুরুবিশেষ।

নাম জুন পাইকের এমন শিল্পকর্মের স্বাদ নেয়ার আগ্রহ ছিল অনেক দিনের। Kitchen আয়োজিত সুযোগটি তাই হাতছাড়া করিনি এবং বলতে দ্বিধা নেই যে সে অভিজ্ঞতাটি ছিল একেবারেই অভাবিতপূর্ব। মানুষের উদ্ভাবনক্ষমতা কতদূর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে নাম জুন পাইকের সেদিনের পারফরম্যান্স না দেখলে তা ধারণার বাইরেই থেকে যেত। তার সেদিনের উপস্থাপনার দুটো দৃষ্টান্ত দিই। হলে ঢুকতেই দেখা যায় একটি বড় পর্দা। তাতে একটি বিমূর্ত চিত্রের প্রক্ষেপণ। মঞ্চের দুই পাশে দর্শকের দিকে মুখ করা দুই খানা টিভি মনিটরেও সেই একই ছবি। মঞ্চের সামনে মেঝেতে ছড়ানো-ছিটানো ভিডিও প্রজেক্টর, ক্যামেরা ও আরো টুকটাক যন্ত্রপাতি। আর ছিল একপাশে একটি মই ও অন্যপাশে একখানা পিয়ানো। ষাটোর্ধ্ব নাম জুন পাইক অত্যন্ত সাদাসিধে বেশে মঞ্চে এসে জন কেইজের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে মই বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। আর তার এক সহকারী এসে মইয়ের নিচে হাঁটু গেড়ে বসে কী একটা পাত্রের মতো ধরলেন। আর নাম জুন পাইক বলা নেই কওয়া নেই একখানা কাঁচি বের করে নিজের মাথার চুল কেটে ওপর থেকে সেই পাত্রের মধ্যে ফেলতে লাগলেন। অমনি পর্দায় ফুটে উঠতে লাগল তার সেই চুলের বিচিত্র বিন্যাসের ছবি, বোঝা গেল সেটি নিরীহ একটি পাত্র মাত্র নয়, তার গায়ে বসানো রয়েছে ক্যামেরা। সেই ক্যামেরা শিল্পীর চুলের পতনভঙ্গি ও বিমূর্ত বিন্যাসের ছবি তুলে ভিডিও প্রজেক্টরের ভেতর দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে পর্দায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। এরই মধ্যে তৃষ্ণার্ত শিল্পী একগ্লাস জল পান করে কুলকুচো করে সেই জলই ফেলতে লাগলেন ওই পাত্রে, তার কর্তিত কেশের ওপর। আর আমরা পর্দায় দেখতে পেলাম জলতরঙ্গের মধ্যে এলোমেলো ভাসমান গুল্মের দলবিশেষ। এখানেই শেষ নয়। তিনি এরপর তার সহকারীর বাড়িয়ে দেয়া একখানি রঙিন আইসক্রিম খেতে খেতে তার অংশবিশেষ ছুড়ে দিলেন নিচের পাত্রে, যা সেই সাদাকালো চিত্রে অভিনব এক রঙের সঞ্চার করে। সব মিলিয়ে পর্দায় ক্রমে ফুটে উঠতে থাকে এক আশ্চর্য বিমূর্ত নিসর্গচিত্র যেন। 

এভাবে শিল্পী তার নিজের হাতে নিজেরই কাটা চুলে কুলকুচো করা জল আর আইসক্রিম মিশিয়ে কিছুক্ষণ ভিডিও ছবি এঁকে গিয়ে বসলেন পিয়ানোতে এবং গভীর মনোযোগের সঙ্গে তা বাজাতে শুরু করলেন। তবে আঙুল দিয়ে নয়, একখানা শক্তিশালী ছোট্ট ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে। ফলে একদিকে আমরা যেমন সংগীত শুনছিলাম, অন্যদিকে পর্দায় দেখতে পাচ্ছিলাম যন্ত্রটি থেকে যে সুর ভেসে আসছিল তারও ছবি। বিশেষ করে বিচিত্র অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা সাদাকালো রিডগুলোর অভিনব বিন্যাসের ছবি, যা কোনো চিত্রকলা থেকে কোনো অংশে কম নয়। নাম জুন পাইক মাঝে মধ্যেই রিড থেকে ক্যামেরা তুলে নিয়ে স্থাপন করছিলেন তার চোখে, মুখে, নাকে এমনকি সদ্য কর্তিত কেশ মস্তকেরও আশপাশে। আর আমরা তখন সামনের পর্দায় দেখতে পাচ্ছিলাম সুরের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের এবং বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তার বাদকেরও নানা অভিব্যক্তি। সব মিলিয়ে এক ভিন্ন রকম ত্রিমাত্রিক ছবি, যার উৎস ভিডিও টেকনোলজি আর নাম জুন পাইকের বিস্ময়কর কল্পনা প্রতিভা। শিল্পী কিন্তু এতেই সন্তুষ্ট নন; এক পর্যায়ে সংগীতের সব ব্যাকরণের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পিয়ানোর পেছন দিকে যে জটিল তারের বিন্যাস, সেসবের ওপরেও আঁচড় কাটতে লাগলেন ক্যামেরা দিয়ে, আর সিগারেট খেতে খেতে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলেন ক্যামেরার দিকে, অন্য হাতে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে নাড়াতে লাগলেন পিয়ানোর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। ফলাফল রূপে আমরা পেলাম অন্যতর এক ব্যাকরণ ভাঙা সংগীতের সুর, আর পর্দায় ধোঁয়া, অগ্নিশিখা এবং পিয়ানোর কর্ডগুলোয় জড়াজড়ি করে থাকা এক অত্যাশ্চর্য চিত্রকলা। 

এভাবে প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে নাম জুন পাইক তার আশ্চর্য উদ্ভাবনী শক্তি আর বিশ্বস্ত ভিডিও ক্যামেরার কৌশলে বিস্মিত, বিমুগ্ধ করে আমাদের যেন নিয়ে গিয়েছিলেন অন্যতর এক শিল্পের ভুবনে। মানুষের কল্পনাশক্তির যে সত্যি কোনো শেষ নেই, সে কথা সেদিন নতুন করে উপলব্ধি করেছিলাম। বিশ্ববিশ্রুত এ নিরীক্ষাধর্মী দৃশ্যশিল্পীকে আমাদের সুগভীর শ্রদ্ধা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন