পোর্ট্রেটের পেছনের মুখ

হোসেন সুহি

মোনালিসা। ছবি: ল্যুভ মিউজিয়াম, ভার্মিয়ারের গার্ল উইথ আ পার্ল ইয়ারিং ছবি: মরিটাস মিউজিয়াম, হেগ

মোনালিসা: মোনালিসাকে বিশ্বের সবচেয়ে দামি পেইন্টিং হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পেইন্টিংয়ের এ মোনালিসা কার মুখ তা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। ধারণা করা হয়, ফ্রান্সেসকো দেল গিওকন্ডো নামে এক ধনী সিল্ক ব্যবসায়ী তার ছোট পুত্রের জন্মদিন উপলক্ষে স্ত্রীর প্রতিকৃতি আঁকতে অনুরোধ করেছিলেন শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে। ব্যবসায়ী নিজের নতুন বাড়ির দেয়ালে এ ছবি টানাতে চেয়েছিলেন। তাই কয়েক দশক আগ পর্যন্ত সবাই মনে করতেন মোনাসিলা সেই ব্যবসায়ীর স্ত্রী লিসা গেরারদিনির পোর্ট্রেট।

তবে বিশেষজ্ঞ ও তাত্ত্বিকদের মধ্যে মোনালিসার পরিচয় নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। বলা হয়, সে সময় ইতালিতে নারীদের সম্বোধন করা হতো মোনা বলে। মোনা অর্থাৎ ম্যাডাম। সেই থেকেই হয়তো শিল্পী ভিঞ্চি মোনালিসা নামকরণ করেছিলেন। দীর্ঘ ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মোনালিসা আঁকার কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন লিওনার্দো। এ চিত্রকর্মের বিশেষত্ব হচ্ছে ছবিটি আঁকতে লিওনার্দো কোনো লাইন বা রূপরেখা ব্যবহার করেননি। ১৫ শতকে চিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্রে রূপরেখা বা লাইন তৈরি করে আঁকা ছিল খুব সাধারণ চর্চা। আলো ও ছায়ার বিভ্রম তৈরি করে বিভিন্ন রঙের ব্যবহার ছিল ছবিতে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছবিতে মোনালিসার ভ্রু ও চোখের পাপড়ি যত হালকা হয়ে আসছে ততই মনে হচ্ছে মোনালিসার জনপ্রিয়তা বাড়ছে।

গার্ল উইথ আ পার্ল ইয়ারিং : বিখ্যাত ডাচ চিত্রকর জোহান ভার্মিয়ারের ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে আঁকা একটি বিখ্যাত তৈলচিত্র এটি। অঙ্কিত চিত্রে যে তরুণীকে দেখা যায় তিনি কেবলই একজন গৃহকর্মী হিসেবে এসেছিলেন চিত্রকর জোহান ভার্মিয়ারের বাড়িতে। তরুণীর বয়স তখন ১৬ বছর। তরুণীর শান্ত ও সংবেদনশীল আচরণ, মুখভঙ্গি কেবল গৃহস্থালি কাজে নয়, সেই সঙ্গে চিত্রকর্মেও ভার্মিয়ারকেও সহায়তা করেছিল। 

ভার্মিয়ার ধীরে ধীরে তরুণীকে তার রঙ-তুলির জগতে হাজির করেন—গৃহস্থালি পরিবেশে একাকী নারীর শান্ত, দীপ্তিমান চিত্র। এ তরুণীর নাম ছিল গ্রিয়েট। জোহান ভার্মিয়ারের স্টুডিও, যেখানে তিনি ছবি আঁকতেন সেখানেও গ্রিয়েটকে সময় দিতে হতো। এতে শিল্পী জোহান ভার্মিয়ার তার চিত্রাঙ্কনের ধরনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। যদিও তরুণী গ্রিয়েটের সঙ্গে অনেক বেশি সময় কাটানো নিয়ে পারিবারিক কলহের মুখে পড়তে হয়েছিল এ শিল্পীকে।

লা ভেলাটা:

বলা হয়, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসার বিপরীতে নারীকে নিজস্ব ভাবনায় রূপ দিতে চেয়েছিলেন রেনেসাঁর আরেক বিখ্যাত শিল্পী রাফায়েল সানজিও। নারীর সৌন্দর্য এবং স্বাভাবিক রূপকে তুলে ধরতে তিনি এঁকেছেন ‘লা ভেলাটা’। শিল্প ইতিহাসবিদরা রাফায়েল-অঙ্কিত এ নারীর প্রতিকৃতির নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তারা মনে করেন, এ নারী হতে পারেন শিল্পীর প্রমিকা বা তার কোনো পৃষ্ঠপোষকের স্ত্রী। এ নারীকে রাফায়েলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকর্মের মডেল হিসেবে দেখা গেছে। কেননা ‘লা ভেলাটা’ ও ‘লা ফরনানিনা’র মডেল একই ব্যক্তি।

লা ভেলাটার অঙ্কনশৈলী নিয়েও আছে বিভিন্ন মত। রাফায়েলের আঁকা এর আগের নারী প্রতিকৃতিগুলোর তুলনায় লা ভেলাটায় তিনি গায়ের রঙ ও পোশাকের ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। চিত্রে দেখা যায় ত্বকের বর্ণ ও পোশাকের রঙের মধ্যে এক ধরনের সামঞ্জস্য আছে, যা ছবিটিকে আরো দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তোলে। রাফায়েলের পূর্ববর্তী সময়ে সাধারণত চিত্রকর্মে যেভাবে নারীকে আঁকা হতো, রাফায়েল সে তুলনায় ভিন্ন পথে হেঁটেছেন। লা ভেলাটায় মডেলের মুখ উজ্জ্বল। মূলত অন্ধকার পশ্চাৎপদের কারণে তার ডিম্বাকার মুখটি বেশি উজ্জ্বলতা পেয়েছে। পাশাপাশি লক্ষ করে দেখার মতো বিষয় হলো ছবিতে মডেলের চোখ যেকোনো দর্শককে থামিয়ে দেবে। পোশাকের হাতা ও নারীর হাতের ত্বকের আইভরি রঙ সামঞ্জস্য পেয়েছে। পোশাকের মধ্যে থাকা সোনালি সূচিকর্ম পুরো পোশাকের পাশাপাশি ছবিটিকেও ফুটিয়ে তুলেছিল।

রাফায়েলের আঁকা এর আগের প্রতিকৃতিগুলোর মধ্যে এক ধরনের আড়ষ্ট ভাব ছিল। কিন্তু এ প্রতিকৃতি সহজ সাধারণ একটি চিত্রকর্ম হয়েও ভাবনায় একটি বৃহত্তর ভাবনার জায়গা তৈরি করেছে। এ কারণেই রাফায়েল গ্রেট ভেনেশীয় চিত্রশিল্পী জর্জিওন ও টিসিয়ানের সমতুল্য স্থান পান। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন