চিটাগং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি

একদিকে পড়াশোনা, অন্যদিকে গবেষণা

ফিচার প্রতিবেদক

‘সিআইইউ তোমার/সিআইইউ আমার/ সবার অহংকার’—চিটাগং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির (সিআইইউর) থিম সংয়ের মতোই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রিয় এক বিদ্যাপীঠ এ বিশ্ববিদ্যালয়। নগরের ব্যস্ততম জামালখান সড়কের পশ্চিম পাশে ওপরের দিকে উঠে গেছে পাহাড়ি ঢালু রাস্তা। এ রাস্তা ধরে একটু সামনে এগোলে তারুণ্যমুখর বিশ্ববিদ্যালয় সিআইইউ। ভেতরে ঢুকলেই মনে হবে এ যেন শিক্ষার অন্য ভুবন। শিক্ষার্থীরা গলা ছেড়ে গান গাইছে, শিক্ষকরা ব্যস্ত গবেষণা আর পাঠদানে। ওদিকে লাইব্রেরিতে পড়ুয়াদের ভিড়। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ দেখে সত্যি মন ভালো হয়ে যায়। কী নেই এখানে জ্ঞান অর্জনের? সকাল থেকে সন্ধ্যা—ব্যস্ত সময় কাটে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের

নিয়মিত বের হচ্ছে সিআইইউ জার্নাল

ঝকঝকে পৃষ্ঠা আর নজরকাড়া মলাট। সেই জার্নালে চিটাগং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির (সিআইইউ) শিক্ষকদের পাশাপাশি ঠাঁই পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া ও কাজাখস্তানের খ্যাতনামা গবেষকদের প্রবন্ধ। গত বছরের ডিসেম্বরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বের করা জার্নালটি আলোচিত হয়েছে চট্টগ্রামের শিক্ষা মহলে। আন্তর্জাতিক মানের এ জার্নাল প্রকাশের মাধ্যমে পাঠদান আর জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি গবেষণা কার্যক্রমে যেন আরো অধিকতর মনোযোগ দেয়ার কথা জানান দিল সিআইইউ। প্রতি বছরের ডিসেম্বরে দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা শিক্ষকদের গবেষণাধর্মী এমন প্রচুর লেখা ঠাঁই পাচ্ছে সিআইইউর জার্নালে। শুধু আন্তর্জাতিক জার্নাল প্রকাশ করা নয়, এমফিল-পিএইচডি-ডক্টরেট পোস্টডক্টরেট ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া, শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা, ক্লাসরুমের বাইরে ব্যবহারিক শিক্ষার সঙ্গে সমন্বয় করে সিলেবাস তৈরি, নিত্যনতুন বিষয় কোর্স-কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা, ক্লাব কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল মানসিকতা বাড়ানো, ল্যাব সুবিধা বৃদ্ধি করা, দেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ শিক্ষা কার্যক্রম চালু করাসহ নানা বিষয়ে চট্টগ্রামের বেসরকারি বিশ্বববিদ্যালয়গুলোর ভেতর এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে সিআইইউ। আর সে কারণে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের আস্থার প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম কুড়াচ্ছে এ বিদ্যাপীঠ। 

এগিয়ে চলার গল্প

১৯৯৯ সালে ঢাকার ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শাখা ক্যাম্পাস হিসেবে সিআইইউর যাত্রা শুরু চট্টগ্রামে। ১২ জামালখান রোডের মোড়ে পশ্চিমে ঢালু পাহাড় বেয়ে উঠে গেছে পাকা রাস্তা। আর এ সড়ক ধরে এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে সিআইইউ ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের পরিবেশটাই মন ভালো করে দেয়। একেবারে ফটকের মুখেই শহীদ মিনার। তার অদূরে সারি সারি বেঞ্চ। সেখানে আড্ডা জমেছে বেশ। কেউ গান ধরেছে গিটার হাতে। কেউবা পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত। 

২০১৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের অনুমোদন লাভ করে সিআইইউ। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি অনুষদ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে: বিজনেস স্কুল, স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, স্কুল অব লিবারেল আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস এবং স্কুল অব ল। বর্তমানে তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর গবেষণা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে আলাদা একটি সেন্টার। এই সেন্টার বিভিন্ন অনুষদের গবেষণাকাজের ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে। এছাড়া গবেষণাকাজে সহায়তা প্রদান করার জন্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা তহবিলও। 

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে থাকেন এবং তাদের প্রবন্ধগুলো এরই মধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সিআইইউ জার্নালটি নিয়মিত প্রকাশের জন্য রয়েছে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সম্পাদকীয় বোর্ড। অনলাইন ও প্রিন্ট—দুটো ভার্সনেই পড়া যাবে জার্নালটি।

শিক্ষার্থীদের ঝুলিতে একাধিক সাফল্য 

সিআইইউর শিক্ষার্থীরা কেবল পড়ালেখা নয়, সৃষ্টিশীল নানা কর্মকাণ্ডেও  নিয়ে আসছেন সাফল্যের পুরস্কার। আর তাদের এ সাফল্যে গর্বিত চট্টগ্রামের শিক্ষা মহলও। নিত্যনতুন আইডিয়া আর ব্যবসায়িক নানা ধারণা দিয়ে পুরস্কার পেয়েছেন দেশের একাধিক প্রতিযোগিতায়। রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ ২০২৩ প্রতিযোগিতায় পৃথকভাবে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ হয়েছে সিআইইউর ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ দল। মানে দুটি সাফল্য পেয়েছেন শিক্ষার্থীরা। চ্যাম্পিয়ন দলের দলনেতা শিক্ষার্থী রিয়াদুল হক বলেন, এমন আয়োজন আমাদের ভবিষ্যতে বড় উদ্ভাবক হওয়ার স্বপ্ন দেখাবে। 

অন্যদিকে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল (জেসিআই) চট্টগ্রাম আয়োজিত ‘স্ট্যার্টআপ বিজনেস আইডিয়া কনটেস্ট’ প্রতিযোগিতায় বড় সাফল্য দেখিয়েছেন সিআইইউর শিক্ষার্থীরা। প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ হওয়ার পুরস্কার দুটোই নিজেদের ঘরে তুলে নিয়েছেন দুই দলের প্রতিযোগীরা। প্রতিযোগিতায় সিআইইউ ছাড়াও চট্টগ্রামের একাধিক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। বিজয়ী চ্যাম্পিয়ন দলের শিক্ষার্থী সাইদুল আজহার ঋষি বলেন, ছোট্ট আইডিয়া থেকেই বড় কিছু হয়। চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলের সদস্যরা যে দুটো বিষয় নিয়ে কাজ করেছে, হয়তো ভবিষ্যতে এমন চমৎকার ভাবনা থেকে আমাদের অর্থনীতি আরো গতিশীল হবে—এমনটা বিশ্বাস আমার।  

এদিকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ফিলিপ সি জেসাপ ইন্টারন্যাশনাল ল মুট কোর্ট প্রতিযোগিতায় সেরা নতুন দলের পুরস্কার পায় সিআইইউর আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের একটি দল। বিশ্বের সমসাময়িক আইনি বিষয়ের নানান ইস্যু নিয়ে ১৯৬০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের আদলে এই মুট কোর্ট প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো মুট কোর্ট প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে দেশের আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছে।

শিক্ষায় সমঝোতা স্মারক

শিক্ষার মানোন্নয়নে যৌথভাবে কাজ করতে দেশ-বিদেশের ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা এবং যৌথ কার্যক্রম চালু রয়েছে সিআইইউর। এর মধ্যে অন্যতম হলো কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ফ্রান্সের বিখ্যাত ট্রিপল অ্যাক্রিডিটেড বিজনেস স্কুল-রেন স্কুল অব বিজনেস (আরএসবি), আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অ্যালাবামা, মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব উতারা, ভারতের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, পেশাজীবীদের গ্লোবাল সংস্থা দি অ্যাসোসিয়েশন অব চার্টার্ড সার্টিফায়েড অ্যাকাউন্টস (এসিসিএ), স্কলার ট্রুপ,  দেশে এনবিআর, সিটি ব্যাংক আলো সার্টিফিকেশন প্রোগ্রাম ইত্যাদি। সিআইইউ নর্থ আমেরিকান কারিকুলাম কোর্সের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে আসছে। ফলে শিক্ষার্থীরা চাইলে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার ভালো সুযোগ পায়। মাল্টিমিডিয়া ও কম্পিউটার সাপোর্টে সজ্জিত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শ্রেণীকক্ষ, অত্যাধুনিক ল্যাব এবং লাইব্রেরি এরই মধ্যে চট্টগ্রামে বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম এনে দিয়েছে। সিআইইউর অত্যাধুনিক আইটি সুবিধা এবং ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক একুশ শতাব্দীর চাহিদা পূরণ করে আসছে। 

শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলছে এলএফই প্রোগ্রাম 

সিআইইউর শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার বাইরে একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে পরিচালিত হয় কিংবা করপোরেট বিশ্ব কীভাবে চলছে সে বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের ধারণা নিতে লাইভ ইন ফিল্ড এক্সপেরিয়েন্স (এলএফই) কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এতে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে ধারণা পাচ্ছে, তেমনি তাদের জ্ঞানের অভিজ্ঞতার সঙ্গে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ হচ্ছে। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, স্টক একচেঞ্জ, বিদ্যুৎ স্টেশন, আমদানি-রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান কিংবা সিলেটের দুর্গম অঞ্চলে গিয়ে ছেলেমেয়েরা দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করেন। এরপর গবেষণার বিষয় অনুযায়ী সেখানকার মাঠ পর্যায়ের চিত্র পড়ে প্রতিবেদন আকারে জমা দেন। এতে তাদের ভেতর গবেষণা কার্যক্রমের মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। এলএফই কার্যক্রমটি সিআইইউর চারটি স্কুলের জন্য প্রযোজ্য। প্রোগ্রামটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভেতর উচ্ছ্বাসের কমতি নেই।

শিক্ষার মানোন্নয়নে একাধিক ইনস্টিটিউট

সিআইইউতে ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ নামে রয়েছে একটি পৃথক ইনস্টিটিউট। ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী এখানে গঠন করা হয়েছে ইনস্টিটিউশনাল অব কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সেল বা আইকিউএসি। এছাড়া আছে সেন্টার ফর অ্যাকসিল্যান্স ফর টিচিং অ্যান্ড লার্নিং (সিইটিএল) নামে আরেকটি ইনস্টিটিউট। রয়েছে ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার (ইএলসি)। স্বতন্ত্র পরিচালকের মাধ্যমে এগুলোর কার্যক্রম চলছে বেশ জোরেশোরে। আছে সেন্টার ফর অন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ, ইনোভেশন, অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট (সিআইইউ-সিইআইএসডি)। মূলত সিআইইউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, মালয়েশিয়া, ভারত, কাজাখস্তান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গেই এখন বেশি কাজ করছে। ফলে তাদের সঙ্গে গবেষণা নেটওয়ার্ক, ফ্যাকাল্টি এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম, ডিগ্রি প্রোগ্রামের মূল্যায়ন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বোত্তম সম্ভাব্য শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যমান কোর্স কারিকুলাম আপডেট করার সুযোগ পাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন