পুথির খোঁজে চকবাজার থেকে বাংলাবাজার

মো. মোস্তাফিজুর রহমান পলাশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাণ্ডুলিপি শাখা থেকে প্রাপ্ত  ‘পাণ্ডুলিপি পাঠোদ্ধার ও সম্পাদনা’ গবেষণা প্রকল্পের রিসার্চ মনোগ্রাফের নানা বিষয় নিয়ে প্রায়ই ইতিহাস বিভাগের শহিদুল হাসান স্যারের রুমে গিয়ে উনার প্রয়োজনীয় পরামর্শ গ্রহণ করি। তিনি নিজে পুথি গবেষক, পুথি পড়তে পারেন। আমার পুথিপাঠ বিদ্যার হাতেখড়ি হয়েছে স্যারের কাছেই। এ বছরের শুরুতেই, জানুয়ারির ২ তারিখে স্যারের কাছে গিয়েছিলাম পাণ্ডুলিপি বিষয়ক গবেষণার জন্য দরকারি আলাপ সারতে। পড়াশোনার আলোচনা শেষ হলে স্যার হঠাৎ বলেন, চল আজ চকবাজার থেকে ঘুরে আসি। যেই কথা সেই কাজ। স্যার আর আমি আনুমানিক বিকাল সাড়ে চারটায় রিকশাযোগে রওয়ানা হলাম চকবাজারের উদ্দেশ্যে। উল্লেখ্য, গত বছরের ১২ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ভানোর ইউনিয়নের অন্তর্গত বিশ্রামপুর গ্রাম থেকে মধ্যযুগে প্রচলিত ছিল এমন পাঁচটি পুথির ছাপা সংস্করণ পাওয়া গেছে যেগুলো বর্তমানে আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে। প্রাপ্ত পাঁচটি পুথির মধ্যে দুটির কভার পৃষ্ঠা থেকে প্রকাশনা সংস্থার নাম জানা যায় হামিদিয়া লাইব্রেরী এবং সোলেমানিয়া লাইব্রেরী। গুগলের সাহায্যে সোলেমানিয়া লাইব্রেরীর অবস্থান বাংলাবাজার জানা গেলেও হামিদিয়া লাইব্রেরীর অবস্থান জানা যাচ্ছিল না (গুগল কখনো দেখাচ্ছিল হামিদিয়া লাইব্রেরী চকবাজারে। আবার কখনো দেখাচ্ছিল চকরোড, বাংলাবাজার)। তবে সেদিন বাংলাবাজার যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা আমাদের ছিল না

রিক্সা থেকে নেমেই স্যার প্রথমে চকবাজার শাহী মসজিদের লিপি দেখতে যান। আমি অবশ্য মসজিদের নিচেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। স্যার মসজিদ থেকে নিচে নামলে পাশে অস্থায়ীভাবে বসা একটা দোকান থেকে সিদ্ধ ডিম খাচ্ছিলাম। স্যারের হঠাৎ চোখ পড়ে আমাদের ঠিক পিছনে থাকা সাইনবোর্ডের দিকে। সাইনবোর্ডে লেখা হামিদিয়া লাইব্রেরী। আমরা দুজনই মহাখুশি! যে হামিদিয়া লাইব্রেরীর অবস্থান নিয়ে অন্ধকারে ছিলাম, সে দেখা দিল চোখের সামনে।

মধ্যযুগে বর্তমান সময়ের মতো পরিকল্পিতভাবে ইতিহাস গ্রন্থ রচিত না হওয়ায় সে সময়ের ইতিহাস পুনর্গঠনে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের মতো সেকালের পুথি আকর সূত্র বা প্রাথমিক উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর ইতিহাস গবেষক মাত্রই জানেন ইতিহাস রচনায় আকরসূত্রের গুরুত্ব। লাইব্রেরীর সাইনবোর্ডের মতো লাইব্রেরীর অবস্থাও জীর্ণ। লাইব্রেরীর ভিতরে প্রবেশ করে মালিকের সঙ্গে কথা বলছিলাম পুথি নিয়ে। লাইব্রেরীর মালিকের ভাষ্য এখানে তার জবানিতেই তুলে ধরলাম “আমাদের কাছে এখন পুথি নেই। ২০০৭-২০০৮ সাল পর্যন্ত পুথির চাহিদা ছিল। তবে স্মার্টফোন আসার ফলে মানুষের পুথির প্রতি আকর্ষণ কমে গেছে এবং একপর্যায়ে পুথি বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। তাই আমরাও পুথি ছাপানো বন্ধ করে দিই। পুথি ছাপানোর ছাঁচগুলোও আমরা পুড়িয়ে ফেলেছি প্রয়োজন না থাকায়।”

হামিদিয়া লাইব্রেরীর মালিকের কথা আমাদের কিছুটা আশাহত করলেও উনি অবশ্য কয়েক মিটার দূরত্বে থাকা আল আমিন লাইব্রেরীতে পুথি থাকতে পারে বলে জানান। সেখান থেকে আমরা চক মসজিদের নিচের তলার মার্কেটের ভিতরে আল আমিন লাইব্রেরী খুঁজে বের করি। বেচাকেনায় ব্যস্ত থাকা লাইব্রেরির মালিকের সাথে কথা বলে জানতে পারি তারাও পুথি ছাপান না এবং তাদের সংগ্রহে কোনো পুথি নেই। আল আমিন এবং হামিদিয়া উভয় লাইব্রেরী এখন কোরআন শরীফ ও অন্যান্য ধর্মীয় বই ছাপান। আল আমিন লাইব্রেরীর মালিক বলেন, “পুথি বিক্রি করত যেসব দোকান, ওই দোকানগুলো এখন তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। তবে বাংলাবাজারে গেলে হয়তো পুথির সন্ধান পেলেও পেতে পারেন।” এছাড়াও সোলেমানিয়া লাইব্রেরীর কার্ড আমাদের হাতে দিয়ে বলেন, “এই দোকানে পুথি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।” এরপর সেখান থেকে রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি বাংলাবাজারের উদ্দেশ্যে। কারণ পুথিপ্রেমী আমরা দুইজন পুথি প্রকাশনার এই রহস্য উদঘাটন না করা পর্যন্ত ফিরে আসতে রাজি ছিলাম না। আমাদের নতুন গন্তব্য হয় ৩৬, বাংলাবাজার।

চকবাজার থেকে সদরঘাটের চিপা রাস্তা দিয়ে বাংলা বাজারের কাছাকাছি যেতে পারলেও একপর্যায়ে অতিরিক্ত জ্যামের কারণে রিক্সা আর সামনে যেতে পারছিল না। হাটতে হাটতে হাজির হয়ে গেলাম বাংলাবাজার বইয়ের মার্কেটে। এরপর কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত লাইব্রেরীতে। সোলেমানিয়া লাইব্রেরীতে পুথির উপস্থিতি দেখে আমরা বেশ অবাক-ই হয়ে যায়। মধ্যযুগে প্রচলিত এসব পুথি একুশ শতকেও দোকানে বিক্রি হচ্ছে! এর মাধ্যমে আধুনিক সময়েও এসব পুথির জনপ্রিয়তা ছিল বলে অনুমান করা যায়। তবে আমাদের সংগ্রহীত পুথিগুলো ছাপা অক্ষরের হলেও মধ্যযুগে মূলত ছাপাখানার অনুপস্থিতির জন্য হাতে লিখে পুথি অনুলিপি করা হতো। সোলেমানিয়া লাইব্রেরীর সংগ্রহে থাকা পুথিসমূহ হলো: ছয়ফল মুল্লুক বদিউজ্জামাল, খায়রুল হাশর, আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরীর পুঁথি, গাজি কালু ও চাম্পাবতী কন্যার পুথি, জঙ্গনামা, দেলদার কুমার ও শাহাজাদী দিল পিঞ্জির কিচ্ছা, দোয়ায়ে গাঞ্জল আরশ, বড় ছায়েত নামা। সোলেমানিয়া লাইব্রেরি থেকে সংগৃহীত পুথিসমূহের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় আগ্রহী পাঠকের জন্য তুলে ধরছি:

খায়রুল হাশর: কভার পৃষ্ঠার বর্ণনাআদি ও আসল খায়রুল হাশর। মরহুম মুন্সী আমিরুদ্দিন প্রণীত। প্রকাশক: সোলেমানিয়া বুক হাউস, বাংলাবাজার, ঢাকা। হাদিয়া: ৩২০ টাকা মাত্র। প্রথম প্রকাশ: ১৩৭৪ মাঘ, দ্বাদশ মুদ্রণ: ১৪০৬ আষাঢ়, সংশোধিত মুদ্রণ: জানুয়ারি ২০১৩ ইং, সংশোধিত মুদ্রণ: জানুয়ারি- ২০২২ ইং। মোট পৃষ্ঠা ২৬৪। পৃষ্ঠাগুলো ডান থেকে বামে সন্নিবেশিত অর্থাৎ বটতলার পুথির স্টাইলে। হযরত আদম, হাবিল-কাবিল, নুহ নবি, ইব্রাহিম নবি, নবি মুহাম্মদ (সা.), হযরত ইসমাইল (আ.) এর কুরবানি প্রভৃতি বিষয়সমূহ নিয়ে বইটি বিন্যস্ত।


জঙ্গনামা: কভার পৃষ্ঠার বর্ণনাআদি ও আসল জঙ্গনামা। মরহুম মুন্সী আমিরুদ্দিন প্রণীত। প্রকাশক: সোলেমানিয়া বুক হাউস। হাদিয়া- কভার পৃষ্ঠায় দেওয়া ৭০ টাকা। তবে ভিতরের পৃষ্ঠায় মূল্য দেওয়া আছে ৩৫০ টাকা। প্রথম প্রকাশ: মাঘ-১৩৭৪ বাংলা, দ্বাদশ মুদ্রণ: আষাঢ়-১৪০৬ বাংলা, পনেরতম মুদ্রণ: অগ্রহায়ণ-১৪৩০ বাংলা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২৮। পৃষ্ঠাগুলো বাম থেকে ডানের দিকে সন্নিবেশিত অর্থাৎ বর্তমান স্টাইলে। বিবি ফাতেমা, ইমাম হাসান, মোহাম্মদ হানিফা প্রভৃতি মুসলিম মনীষীদের ব্যক্তিজীবন, ধর্মীয় জীবন ও যুদ্ধসমূহের কাহিনী নিয়ে এই পুথির অধ্যায়সমূহ বিন্যস্ত।

 

আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরীর পুঁথি: কভার পৃষ্ঠার বর্ণনাছহী বড় আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরীর পুঁথি। মরহুম মুন্সী আমিরুদ্দিন প্রণীত। প্রকাশক: সোলেমানিয়া বুক হাউজ। হাদিয়া: ২০ টাকা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪০। পৃষ্ঠাগুলো ডান থেকে বামে অর্থাৎ বটতলার স্টাইলে।

দেলদার কুমার ও শাহাজাদী দিল পিঞ্জির কিচ্ছা: কভার পৃষ্ঠার বর্ণনাআদি ও আসল দেলদার কুমার ও শাহাজাদী দিল পিঞ্জির কিচ্ছা। আব্দুল রহিম প্রণীত প্রকাশক- হাসিবিয়া লাইব্রেরী, কলিকাতা-ভারত। সন ১৯৯৫ ইং। মূল্য: ৩৫.০০ টাকা মাত্র। ৮০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির পৃষ্ঠাগুলো বাম থেকে ডানের দিকে সন্নিবেশিত।

গাজি কালু ও চাম্পাবতী কন্যার পুথি: কভার পৃষ্ঠার বর্ণনা- আদি ও আসল ছহি বড় গাজি কালু ও চাম্পাবতী কন্যার পুথি। আব্দুর রহিম প্রণীত। প্রকাশক- সোলেমানিয়া বুক হাউজ। প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি, ১৯৯৫। সংশোধিত সংস্করণ: জানুয়ারি ২০২০ ইং। মূল্য: ৯০ টাকা মাত্র। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৭২ এবং পৃষ্ঠাগুলো বাম থেকে ডানের দিকে সন্নিবেশিত।

দোয়ায়ে গাঞ্জল আরশ: আদি ও আসল দোয়ায়ে গাঞ্জল আরশ। প্রকাশনায়- সোলেমানীয়া বুক হাউস। হাদিয়া- ১৫.০০ টাকা। ৩২ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির পৃষ্ঠাগুলো ডান থেকে বামের দিকে সন্নিবেশিত। এটি মূলত বিভিন্ন আমল ও দোয়ার বই।

বড় ছায়েত নামা: আদি ও আসল বড় ছায়েত নামা। সায়ের মুনসী আমিরুদ্দীন আহমদ সাহেব। সোলেমানীয়া বুক হাউস। হাদিয়া- ৯০ টাকা মাত্র। ৮৮ পৃষ্ঠার বইটির পৃষ্ঠাগুলো বাম থেকে ডানের দিকে সন্নিবেশিত। বিভিন্ন দোয়া ও রাশিমালার বিবরণ ও আমল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই গ্রন্থে।

প্রথম এবং দ্বিতীয় লাইনের শেষ বুঝাতে যথাক্রমে * ও ǁ চিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও মধ্যযুগের শব্দ গঠন বজায় রাখা হয়েছে যেমন: সৃজিলেক (সৃজিল অর্থে)। সর্বশেষ ২০২২ সালে পুন:মুদ্রিত কপি আমাদের হাতে রয়েছে। এতে বোঝা যায়, আধুনিক যুগে এসেও ছাপা অক্ষরের পুথিগুলোতে মধ্যযুগের শব্দ গঠনের রীতি সচেতনভাবেই বজায় রাখা হয়েছে। সোলেমানিয়া বুক হাউসের বর্তমান কর্ণধার বলেন, “কিছু বয়স্ক মানুষ এখনো শখের বসে পুথি পাঠ করেন। তাই তারা নিকটস্থ ডিলারদের শরণাপন্ন হন পুথি কেনার জন্য। এসব ডিলার আবার তাদের কাছ থেকে পুথি নিতে আসেন। তাই কিছু কপি বিক্রির জন্য দোকানে রাখা হয়েছে। তবে এসব পুথির চাহিদা আগের মতো না থাকায় আমরা নতুন করে ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছি এবং পুথি ছাপানোর ছাঁচগুলোও পুড়িয়ে ফেলেছি।” তাদের কাছে জারি বা নবি-রাসূলকে নিয়ে লেখা পুরনো দিনের বই আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন যে তাদের কাছে এসব বই নেই এবং এই মার্কেটে অন্য দোকানেও থাকার সম্ভাবনা নেই। তবে পাশের মান্নান মার্কেটের সালমা লাইব্রেরীতে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমরা যখন সালমা লাইব্রেরীতে যাই, তখন দোকানটি বন্ধ ছিল। সালমা লাইব্রেরীর পাশের দোকানে এ ধরণের বই আর কোথায় পাওয়া যেতে পারে জিজ্ঞেস করলে উনি জানান যে পাশের রাস্তার ফুটপাতে ভ্যানে একজন দোকানদার বই বিক্রি করেন। তার কাছে থাকতে পারে।

ফুটপাতের সেই দোকানও পাওয়া গেল কিছু বই । নিচে সে সব বইয়ের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করছি:

মালেক দেওয়ানের ভাব সঙ্গীত ১ম ও ২য় খণ্ড, জ্ঞানের সন্ধানে দেওয়ান গীতি ১ম ও ২য় খণ্ড, আক্কাস গীতি ১ম, ২য় ও ৪র্থ খণ্ড, মোসলেমউদ্দিন বয়াতীর জারীগানের পালা, কবিয়াল বিজয় সরকারের বিচ্ছেদী ও কবি গান, আবুল গীতি, রূপদর্শন আবুল গীতি ৩য় খণ্ড, খালেক দেওয়ানের জারী গান, হযরত ফাতেমা (রা.), শরিয়তি, মারফতি ও ভক্তি মূলক গানের সংকলন তত্ত্ব সংরক্ষণ।

এই বইগুলি হয়তো আঞ্চলিক পর্যায়ে ধর্মীয় ও লোক গীতি এবং শাস্ত্রীয় বিষয় সম্পর্কে চর্চার নতুন কোন দিক নির্দেশনা দেবেএটাই ছিল আমাদের অনুসন্ধানের প্রত্যাশা। পুরনো দিনের বই তথা ঐতিহ্য সংগ্রহের যাত্রা সেদিনের মতো শেষ হয়। আমি এই অনুসন্ধানের নাম দিয়েছি “Historical Excavation”

 

মো. মোস্তাফিজুর রহমান পলাশ, শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

E-mail: palash.mrp354@gmail.com

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন