ভ্যান গঘের ব্যান্ডেজ করা কান

শফিকুল কবীর চন্দন

সেলফ পোর্ট্রেট উইথ ব্যান্ডেজড ইয়ার অ্যান্ড পাইপ, ১৮৮৯

আজ থেকে ঠিক ১৩৫ বছর আগে ১৮৮৮ সালের এক শীতের দিন। খ্রিস্টোৎসবের দুদিন আগে ২৩ ডিসেম্বর। আঁকার রাজ্যের একাকী বাঁশিওয়ালা ভ্যান গঘ কেমন যাপন করেছিলেন সে সময়? সেদিন কান কর্তনের আগে তার জানা থাকার কথা নয় যে এবার বাধ্য হয়ে হাসপাতালেই বড়দিন কাটবে। আমরা জানি ঠিক তার দুই বছর পর গ্রীষ্মের একদিন তার জীবন থেকে ছুটি পাওয়া, বলা ভালো রেহাই পাওয়া জীবনের উচাটন থেকে!

‘‌রহস্য ঘেরা’, ‘বেপরোয়া জীবন’, ‘‌অর্থকষ্ট’, ‘‌দুস্থ শিল্পী’, ‘‌অকৃতদার’, ‘‌বাতুল রোগ’, ‘‌বিষাদাক্রান্ত’, ‘‌বাউণ্ডুলে’, ‘‌মেজাজী’, ‘নেশাগ্রস্ততা’, ‘‌প্রেমিক হিসাবে অকৃতকার্য’, ‘‌গণিকা প্রীতি’, ‘‌পেশায় অসফল শিল্পী’, ‘‌মৃগী রোগের তাছির’, ‘‌মাত্র ৩৭ বছর বয়সে আচমকাই আত্মহত্যা করা’ এসব বিশেষায়িত লোকরঞ্জনবাদী বা জনআকর্ষণীয় (!) তকমায় ভূষিত ভ্যান গঘ কিন্তু মৃত্যুর ১৩৫ বছর পরও খুবই প্রাসঙ্গিক। অদ্যাবধি তাকে নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই!

ভ্যান গঘ বা ভিনসেন্ট যে নামেই ডাকা হোক এ নামের সঙ্গে বানানো ‘‌মিথ’-এর মিথস্ক্রিয়া এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যে সে মিথের কথা-বয়ান কান না পাতলেও শোনা যেতে বাধ্য। অনেকটা কলতলার হট্টগোলের মতো! কান না পাতলেও তা হামলে পড়বে হট্টগোলের এ কানকথার বাজারে। কানকথা শ্রবণসংশ্লিষ্ট যোগাযোগ। এখানে কান কর্তনসংশ্লিষ্ট। কান রহস্য! কান কথা। কান কর্তন।

‘‌কান কেটে ভ্যান গঘ 

দিয়েছিল উপহার

বেশ্যাকে,

যে ছুড়ে ফেলে দিল তা

চরম

বিরক্তি ভরে।

হে ভ্যান, পতিতারা তো চায় না

কোনো কান

তারা চায়

মুদ্রা শুধু।

আন্দাজ করতে পারি কেন তুমি ছিলে

এক মহান

শিল্পী; তুমি

বোঝনি যে ছিলে

তার চেয়ে

ঢের বেশি কিছু।’১ 

কান কাটা ভ্যান গঘ!

হয়তো শিল্পী ও শিল্পের সার সত্যটি ততটা গুরুত্বপূর্ণ বা আকর্ষণীয় নয়, যতটা আসলে মানুষ সেসব ঘিরে মুখরোচক গল্প তৈরি করে। আসলে মানুষ বোধহয় সর্বদা গল্পকেই সেরা সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে পছন্দ করে।

সারা পৃথিবী ভ্যান গঘকে জানে একজন পাগল ও ক্ষ্যাপা শিল্পী বলে! নয় সপ্তাহ একসঙ্গে ছবি আঁকার উদ্দেশ্যে ফ্রান্সের দক্ষিণের শহর আর্লেতে এসেছেন দুই শিল্পী—ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ ও পল গগ্যাঁ। এটা ১৮৮৮ সালের ঘটনা। কিন্তু ভ্যান গঘ এক জটিল, দুর্বোধ্য চরিত্র, যার সহজে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় না, যার কোনো সঙ্গী-সাথি নেই; নিঃসঙ্গ একাকী মানুষ সে। কিছু মানুষের জীবনে বিফলতা সফলতা আনে, কিছু মানুষের বিফলতা শেষ পর্যন্ত সফলতায় পরিণত হয়। ভিনসেন্ট কি তেমনই একজন? ভ্যান গঘ নিজের ভাগ্যকে নিজে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। চেয়েছিলেন তার শিল্প কৌশল শিল্পপ্রেমিক মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে; জীবনের কথা, শিল্পের কথা, মানুষের কথা। আমাদের প্রত্যেকের একজন ব্যক্তিগত ভ্যান গঘ চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন ‘‌সৃষ্টির যন্ত্রণায় ও ভালোবাসার অহমিকায়’।

কান কাটার পর বাইরে যাওয়ার মতো অবস্থা হতেই সে একটা বড় টুপিতে কান-মাথা-মুখ ঢেকে হাজির হয়েছিল হঠাৎ পরিচিত স্বদেশী এক মহিলার বাড়িতে এবং খামে ভরা ধুয়ে পরিষ্কার করা সেই কান তুলে দিয়ে বলেছিল: ‘‌এটি আমার স্মৃতিচিহ্ন।’২

ভ্যান গঘের বাম কানের লতির একটি অংশ কেটে ফেলার দশাকে, ঘটনাটিকে তত্ত্ব, কৌতুক, পণ্যদ্রব্য ও প্রচার সংস্কৃতি উচ্চ-অধঃ মানের অনেক গালগল্পের জন্ম দিয়েছে।

শিল্পের ইতিহাসে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের কাটা কানের মতো কৌতূহল তৈরি করেছে আর কয়টি দুর্দশা? মাইকেলেঞ্জেলোর ভাঙা নাক নয়, দেগার অন্ধত্ব নয়, এমনকি তুলুস লোত্রেকের বিকৃত শরীরও নয়। কানের গল্প (এবং কথিত উন্মাদনা যা আত্মবিচ্ছেদের দিকে পরিচালিত করেছিল) মিথের দৃঢ়তার সঙ্গে গুলিয়ে যখনই পৌরাণিক কাহিনীর মোড়কে উপস্থাপন করা হয় তখনই তা নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়।

একেকটা মিডিয়া হুলস্থূল করে এমনকি সকালের খবরেও নতুন কান তত্ত্বের জন্য উৎসর্গীকৃত এয়ারটাইম বরাদ্দ রাখে। শিল্প ইতিহাসবিদরাও মতামত দিচ্ছেন, কেউ কেউ এটিকে ‘‌হগওয়াশ’ বলে অভিহিত করেছেন। এরই মধ্যে ‘‌অতিরিক্ত চাপে’ থাকা ‘‌ভ্যান গঘ বেচারা’ গল্পে জল্পনা-কল্পনার একটির পর আরেকটি স্তর যুক্ত হচ্ছে। এ কানকথার মিথে সারা বিশ্বের লোকেরা অনুকম্পা ও করুণায় ভ্যান গঘ উপস্থাপনে জড়িয়ে পড়ে স্বাচ্ছন্দ্যে।

বিলকুল বিশ্বাসের মতো বানোয়াট শব্দার্থে কান কাটা ভান গঘের ছবি দেখে উৎসাহীদের বলতে শোনা যায়, সে কথা কম সত্য, বেশি কিংবদন্তি মিশিয়ে শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ ও তার একটি কাটা কান, প্রণয়িনী, দেহপসারিণী, উপহার ইত্যাদি সমেত পরিবেশিত হয়।

কাটা কানের লতি, সামান্য ক্ষতি?

‘‌আমি খেয়েছি তোমার কবর থেকে পাঠানো নীল ক্যারোট ও ভ্যান গঘের কান

এবং পাগলাটে আরতোর ক্যাকটাস।’৩

হলুদ বাড়ির বিক্ষুব্ধ ঝড়ো নয় সপ্তাহ বর্ণনা করতে গিয়ে অনেক কথককেই "বন্য অনুমানে ঝাঁপিয়ে পড়া"হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। শেষ পর্যন্ত এসব থেকে আমরা উৎসাহীরা কি নতুন নতুন তত্ত্বে বশীভূত হই? না একটি বিকল্প পড়া কিংবা দেখার মজার চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে চাই?

যেভাবেই হোক, ১৮৯০ সালে ভ্যান গঘের মৃত্যুর পরের দশকগুলোয়, সেই ‘‌কান বিসর্জন কাণ্ড’ তার নিজের জীবন ছাপিয়ে উঠেছে! বলা ভালো ফেনিয়ে ছাপিয়ে ওঠানো হয়েছে। তার কানের লতি, ভ্রু থেকে লোকরঞ্জনের অনুপ্রেরণাদায়ক কৌতুক, পণ্যদ্রব্য, সিনেমা, সংগীত, অ্যালবাম কভার, গল্প, নাটক এমনকি ইউটিউব ভিডিওগুলো "ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের কানের একটি গুগল অনুসন্ধানও বিস্ময়কর ৯৯ হাজার ৯৯৯ বা তারও বেশি রেফারেন্স দেখাচ্ছে! যার মধ্যে রয়েছে সংঘ, নিউ জার্সির একটি রেস্তোরাঁ, যার নাম ভ্যান গঘ’স ইয়ার ক্যাফে থেকে শুরু করে নানা পদের নামকরণ। নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট ডেবোরা সলোমনের ভাষায়, ‘‌A mass-produced souvenir of artistic torment: a curvy, pinkish rubber object described with typical eBay poetry as ‘Van Gogh’s Ear-squish it, squeeze it!’

যারা আর্ট গ্যালারি বা আর্ট মিউজিয়ামে কখনো পা রাখেননি, যারা শিল্পীদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না, তারাও অন্তত দুটি নাম জানেন: লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ও ভ্যান গঘ, বলেছেন জোয়াকিম পিসারো। ভ্যান গঘ মিথের প্রচলনের একটি কারণ হলো এ পাগলামি সম্পর্কে ধারণাগুলোর বহুল প্রচার। এসব প্রচার ভ্যান গঘের এমন একটি চরিত্র রূপায়ণ করেছে, যা তার শিল্পের চেয়েও যেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং সেসব ঘটে চলেছে যথার্থ স্বাধীন প্রোপাগান্ডার মোড়কে!

‘‌কথা চাই, কথা চাই, হাঁকে

কথার বাজারে;

কথাওয়ালা আসে ঝাঁকে ঝাঁকে

হাজারে হাজারে।

প্রাণে তোর বাণী যদি থাকে

মৌনে ঢাকিয়া রাখ্‌ তাকে

মুখর এ হাটের মাঝারে।’৪

বেশির ভাগ লোক যারা বই পড়েছেন এবং চলচ্চিত্রগুলো দেখেছেন তারা অগত্যা শিল্পকর্ম দেখেন না! জনরুচির স্রোতে গঘ মানুষটার শিল্প সামীপ্যের তাগিদ পাছে আহত হয় তা না ভ্রুক্ষেপ করে কারো মুহূর্তও তর সইছে না যেন। অথচ তাকে তো টপকে দেখার জো নেই, কেননা ‘‌তার জীবন শিল্পকর্ম একটি মর্জির মধ্য দিয়ে দেখা সৃষ্টিরই অংশ।’৫

ব্যান্ডেজ করা কান, চিত্রল আত্মপ্রতিকৃতি

এ বিখ্যাত চিত্রকর্ম, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের ব্যান্ডেজড ইয়ারের সঙ্গে সেলফ-পোর্ট্রেট, তার শৈল্পিক শক্তি এবং ব্যক্তিগত সংগ্রামকে প্রকাশ করে। ভ্যান গঘ হাসপাতাল ছাড়ার এক সপ্তাহ পর ১৮৮৯ সালের জানুয়ারিতে এটি এঁকেছিলেন। তার বাম কানের অংশ কেটে ফেলার পর তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন (এখানে ডান কানের ব্যান্ডেজ হিসেবে দেখানো হয়েছে কারণ তিনি নিজেকে আয়নায় এঁকেছেন)।

কানের লতি না পুরো কান কর্তিত হয়েছিল, আমরা এ রহস্যের সমাধান করতে পারিনি, কিন্তু সব মিলিয়ে এটি কি এত গুরুত্বপূর্ণ? শেষ পর্যন্ত ভ্যান গঘের প্রাণপ্রীতির ফসল চিত্রকর্মগুলোই বরং ঢের আকর্ষণীয় ও রহস্যসঞ্জাত। তার নিজস্ব ভাবনা জগতে বিরোধাভাসের সৌন্দর্যের এ শিল্প দেবতায়তনের স্রষ্টাকে বলাই যায় ‘‌পৃথিবীতে তুমি প্রবাসী এবং অতিথি হয়েই থেকো’।

২৩ ডিসেম্বরও ১৫০ ফ্রাঁ প্রাপ্তি সংবাদ জানিয়ে ভাই থিওকে লেখেছিলেন ভ্যান গঘ। কান কর্তন ঘটনার পর থিওকে প্রথম পত্র লেখেন জানুয়ারি ১৮৯০। এ চিঠিতে সপ্তাহ দিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাপারে একটি বাক্যও ব্যয় করেননি! ঠিক এক মাস পর ২৩ জানুয়ারির পত্রে কেবল এটুকুই উল্লেখ ছিল যে ‘‌অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও আমার জন্য গগ্যাঁ যে সমস্যার মধ্যে পড়েছে সে কথা ভাবলে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়।’

পরিশেষে উদ্ধৃতি কর্জ করে বলা যায়, ‘‌অথচ তাকে নিয়ে বিস্তর ভুল বোঝাবুঝির কারণও নিশ্চয়ই ব্যক্তিমানুষ ও রচয়িতাকে একসঙ্গে দেখতে চাওয়ার তাড়না। ভেবে দেখো, ১৮৯২ সালেই অর্থাৎ শিল্পীর মৃত্যুর বছর দুয়েকের মধ্যেই নেদারল্যান্ডসের শিল্পী রিশার্ড এন রোলান্ড হলসট এ মর্মে ভ্যান গঘের ভক্তদের সতর্ক করতে চেয়েছিলেন: এখানে আমরা সে দুটি বিপজ্জনক শিখর দেখতে পাচ্ছি, যাদের কিনারে ঠোক্কর খেয়ে ভ্যান গঘ বিষয়ে যথার্থ মূল্যাঙ্কন বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। আর সত্যিই তো, এ দুটি শিখর অনেক লেখকের স্বকপোলকল্পনা, যারা তার শিল্পের পরিগ্রহণ, তার ব্যক্তিপ্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছেন, তার উত্তাল সত্তা ও তজ্জনিত ফলাফলের সঙ্গে তাকে একাকার করেই দেখেছেন। ফলত ভ্যান গঘের প্রণীত শিল্প তার জীবনের বিষাদনাট্যের দৃষ্টান্ত বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। এমনকি অবিশেষজ্ঞের কাছেও পুরো ব্যাপারটা হয়ে উঠেছে অপ্রকৃতিস্থ একজন মানুষের রোগনিদানের অভিজ্ঞান।’৬ 

‘সেদিন নভোমণ্ডলীয় শেষকৃত্যে

ভ্যান গঘের সাথে দেখা

হাতে একটি পেন্সিল তুলে দিয়ে বললাম

সাদা কাগজে জীবন এঁকে দেখাও।

ভ্যান গঘ, ওস্তাদ আঁকিয়ে

আমাকে একটি কানের ছবি এঁকে দিয়ে বললেন

এখান থেকে জীবন খুঁজে নাও!’৭

উদ্ধৃতি সূত্র

১. চার্লস বুকোউস্কি।

২. ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ, পল গগ্যাঁ, অর্বাচীন, ১৯৯৭, রূপান্তর-শ্রীধর মুখোপাধ্যায়।

৩. অ্যাপোলিনেয়ারের সমাধিতে, অ্যালেন গিন্সবার্গ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

৫. এমিল জোলা।

৬. অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, প্রমা, ১৯৯৫।

৭. জীবন, নাহিদ ধ্রুব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন