জয়নুলের আধুনিকতা

সুমন ওয়াহিদ

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪-২৮ মে ১৯৭৬)

বিনির্মাণের এই সময়ে দেশ, কাল, সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ অর্থ নির্ণায়ক যেকোনো শব্দকেই আবার সংজ্ঞায়িত করার প্রবণতা লক্ষণীয়। তাই আধুনিকতা বলতে যে পাশ্চাত্য ঘেঁষা আধুনিকতার ছবি আমাদের চোখে ভেসে ওঠে তা পরিবর্তনের সময় হয়তো অনেক আগেই এসেছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সেই আবহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি এখনো। উত্তর আধুনিকতা নিজেই যখন নানা প্রশ্নের সম্মুখীন তখন আবার পেছনে ফিরে আধুনিকতার প্রসঙ্গ নিয়ে আসা আপাতদৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমাদের শিল্পকলায় আধুনিকতাবিষয়ক যে অস্পষ্ট ধারণা বিরাজ করছে সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আবার এ প্রসঙ্গের অবতারণা।

’৫০-’৭০ পর্যন্ত বাংলাদেশের শিল্পকলায় যে আধুনিকতার আমদানি হয়েছিল তা হয়তো অনেকটাই একপেশে। কারণ বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আধুনিক শিল্পভাষা নিয়ে নানা নিরীক্ষার খোঁজ পাওয়া গেলেও আমাদের এখানে আঙ্গিকসর্বস্ব কিউবিজম ও বিমূর্ত ধারারই ঢালাও চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছিল সে সময়। এ প্রসঙ্গে আবুল মনসুর বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিকতার দুর্মর আকর্ষণ এ পর্বে আমাদের অনেক প্রধান শিল্পীকেই দেশজ প্রেক্ষাপট ও পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে অনাগ্রহী করে তোলে।’১ আর বিমূর্ততার ক্ষেত্রে কিছু নিষ্ঠাবান চর্চার উদাহরণ থাকলেও অধিকাংশই আঙ্গিকসর্বস্ব নির্বস্তুক উপস্থাপনায় পর্যবসিত হয়। বিমূর্ততার প্রাথমিক স্তরে যে অধ্যাত্মবাদ বা সরলতার প্রেরণাকে পশ্চিমা শিল্পীরা শিল্প সৃষ্টির উৎস হিসেবে নিয়েছিলেন, তা আমাদের এখানে এসে নিছক অবোধগম্য আঙ্গিকসর্বস্ব শিল্পের নামান্তর হয়ে যায়। তাই কিউবিজম ও অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট দুটোই তৎকালীন সময়ে অনেকটা পোশাকি শিল্প বা ফ্যাশন হিসেবেই এসেছিল এ দেশে; কোনো মানসিক প্রেরণা হিসেবে নয়। ২

ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতায় আমরা নিজের দেশের মানুষকে নিজেরাই স্বীকৃতি দিই না। স্বীকৃতিদানের এ অপসংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্য আমাদের ইতিহাসের প্রারম্ভ থেকেই। বাংলাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সেই ধারাবাহিকতায় জয়নুলের যথার্থ মূল্যায়নও এ দেশে হয়েছে কিনা সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে এ মূলস্রোতের বাইরেও বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবুল মনসুর ও নিসার হোসেনের লেখায় জয়নুলের বিশ্লেষণাত্মক মূল্যায়ন আমাদের নতুন পথে চলার সাহস জোগায়। ভিন্ন একটি দেশে অবস্থান করেও যে তাড়না থেকে শোভন সোম জয়নুলকে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিকোণে মূল্যায়ন করেছেন তা প্রশংসার দাবিদার। নজরুল ইসলাম, মতলুব আলী, সৈয়দ আজিজুল হক প্রমুখের তথ্যবহুল রচনা জয়নুলকে জানার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রেখে চলছে। 

দেশ, কাল, সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিকতাকে মূল্যায়নের চর্চা শুরু হয়েছিল সম্ভবত গত শতকের শেষ দশকে। কিন্তু আধুনিকতা সমালোচনার মুখে পড়েছিল তার অনেক আগেই। পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ আধুনিকতার ভিত্তিমূলে আঘাত করেছিল। যে রবীন্দ্রনাথ একসময় বিশ্ব নাগরিক হতে চেয়েছিলেন, পাশ্চাত্য আধুনিকতার গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন, তিনিও জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সভ্যতার সংকট এ পাশ্চাত্য আধুনিকতা নিয়ে তার হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো যখন তাদের উপনিবেশ ছেড়ে আসতে শুরু করে তখন পাশ্চাত্যের পণ্ডিত ব্যক্তিরাও উপনিবেশকালীন ও উপনিবেশ-পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক আলোকপাত করতে শুরু করেন। তারই ধারাবাহিকতায় উপনিবেশ ছিল এমন অঞ্চলগুলোয় আধুনিকতার স্বরূপ কী হবে তা নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলতে থাকে। ১৯৮৯ সালে রেমন্ড উইলিয়ামস তার The Politics of Modernism : Against the New Conformists গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।৩ গীতা কাপুর ১৯৯২ সালে When was Modernism in India/Third World Art? শীর্ষক লেকচারে ভারতীয় শিল্পে আধুনিকতা নিয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেন।৪ ভারতের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট (National Gallery of Modern Art)-এ Santiniketan : The Making of a Contexual Modernism শীর্ষক প্রদর্শনীতে প্রকাশিত ক্যাটালগে আর শিব কুমার শান্তিনিকেতনে যে আধুনিকতার চর্চা হয়েছিল তাকে Contexual Modernism হিসেবে অভিহিত করেন।৫ যদিও ইউরোপের বাইরে সংগঠিত আধুনিকতাকে পল গিলৌরি Counter Culture of Modernity ও টনি বারলো ঔপনিবেশিক আধুনিকা নামে অভিহিত করতে চাইছেন।৬ কিন্তু অধ্যাপক গল পূর্বোক্তদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে Contexual Modernism-এর পক্ষে তার মত প্রকাশ করেছেন।৭ এক্ষেত্রে কেজি সুব্রামানিয়ানের কথা প্রণিধানযোগ্য। কারণ তিনিও তার বিভিন্ন প্রবন্ধে আধুনিকতা, ভারতীয় আধুনিকতা প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করেছেন।৮

জয়নুলের আধুনিকতাকে বিশ্লেষণ করতে হলে আমরা Contextual modernism-এর সাহায্য নিতে পারি। কারণ শান্তিনিকেতনের Contextual modernism নিয়ে আর শিব কুমার বলেছেন, ‘The Santiniketan artists were one of the first who consciously challenged this idea of modernism by opting out of both internationalist modernism and historicist indigenousness and tried to create a context sensitive modernism.’৯ জয়নুলও একই ধরনের সমন্বয় ও সংশ্লেষণধর্মী প্রাসঙ্গিক আধুনিকতার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যার উদাহরণ আমরা শিল্পাচার্যের সারা জীবনের শিল্প সাধনায় প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে পড়েও তিনি কীভাবে নিজেকে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির গ্রাস থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে নিসার হোসেন তৎকালীন কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে মুকুল দের নেতৃত্বে নতুন প্রণোদনার কথা তার রচনায় উল্লেখ করেছেন।১০ 

জয়নুলের আধুনিকতা মূল্যায়নে শুধু শিল্পকর্মকে নয়, বরং শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও লোকশিল্প জাদুঘর গড়াসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক আবহ নির্মাণে তার ভূমিকাকে বিবেচনায় আনা সংগত।

তথ্যসূত্র

১. আবুল মনসুর, ঔপনিবেশিক পর্ব থেকে সাম্প্রতিককাল, চিত্রকলা, চারু ও কারুকলা (সম্পাদনা: লালা রুখ সেলিম), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-৮, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি (ঢাকা, ২০০৭), ৩৩

২. ১৯৭৪ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জয়নুল বলেন, “...এ ধরনের শিল্পীদের অধিকাংশই কিছুটা অপরিণত বয়সে বিদেশে গিয়েছিল...সেখানে যেসব চিত্রাঙ্কন ধারা দেখেছে, তাতে তাদের চোখ আটকে গিয়েছিল...” নজরুল ইসলাম, জয়নুল আবেদিনের শিল্পভাবনা: একটি সাক্ষাৎকার, সমকালীন শিল্প ও শিল্পী, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি (ঢাকা, ১৯৯৫), ১১৩

৩. Raymond Williams, The Politics of Modernism : Against the New Conformists, Verso (London,), ৩৫

৪. Geeta Kapur, When Was Modernism in Indian Art?, প্রাগুক্ত, ২৯৬-৯৭। গীতা কাপুর ১৯৯২ সালে প্রথম রচনাটি অ্যাশবে ভাষণ (Ashby Lecture) হিসেবে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রদান করেন।

৫. http://humanitiesunderground.org/all-the-shared-experiences-of-the-lived-world-ii/

৬. http://en.wikipedia.org/wiki/Santiniketan: The making of a Contextual Modernism

৭. http://en.wikipedia.org/wiki/Santiniketan: The making of a Contextual Modernism

৮. K.G. Subramanyan, Moving Focus: Eassys on Indian Art, Seagull Books Privet Limited (Kolkata, 2006), উক্ত গ্রন্থটিতে Modern Art in India and the West, Modern Indian Art in the last Three Decades, The Indian Artist and the Socio-Cultural Context প্রভৃতি রচনাগুলো এই প্রাসঙ্গিকতায় প্রণিধানযোগ্য। K.G. Subramanyan, Models of Modern Art, The Creative Circuit, Seagull Books Privet Limited (Kolkata, 1992)

৯. http://en.wikipedia.org/wiki/Santiniketan:The making of a Contextual Modernism

১০. নিসার হোসেন, জয়নুল আবেদিন, চারু ও কারুকলা (সম্পাদনা: লালা রুখ সেলিম), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-৮, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি (ঢাকা, ২০০৭), ২৭৪ 

সুমন ওয়াহিদ: সহকারী অধ্যাপক, অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগ, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন