কোম্পানি আমলে বাঙালি চিত্রশিল্পী হালুদার

আহমেদ দীন রুমি

হালুদারের আঁকা সম্বার হরিণ। ছবি: ব্রিটিশ লাইব্রেরি

২০২০ সালের এপ্রিলের কথা। লন্ডনের ওয়ালেস কালেকশনের ‘‌ফরগটেন মাস্টারস’ প্রদর্শনীর জন্য ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে ২০টি চিত্রকর্ম যায়। তাদের মধ্যে অন্তত চারটি চিত্রকর্ম ছিল অপরিচিত এক বাঙালি চিত্রশিল্পীর। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রদর্শনীতে উঠেছে তার কর্ম। নাম হালুদার, খুব সম্ভবত হালদার পদবির বিকৃত উচ্চারণ। উল্লুক, শ্লথ ভালুক, লম্বা লেজের বানর ও ভারতীয় সম্বার হরিণের মতো অনেক প্রাণীকে তিনি এঁকেছেন নিখুঁত অবয়বে। তার সে মুনশিয়ানা মুগ্ধ করে লাইব্রেরির ভিজুয়াল আর্টস বিভাগের প্রধান মালিনী রায়কে। তিনি হালুদারকে নিয়ে আলোচনা করেন ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের মৎস্যবিজ্ঞানী রালফ ব্রিটজের সঙ্গে। ব্রিটজের কাজের বিষয় বুকাননের লেখা ‘‌ফিশেস অব দ্য গঙ্গা’। হালুদারের সঙ্গে তার পরিচয় নতুন না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফরাসি প্রাণিবিজ্ঞানী হেনরি দ্য ব্লেইনভিলের প্রসঙ্গ তুলে আনেন। ১৮১৬ সালে ব্লেইনভিল সায়েন্স বুলেটিনে হরিণের নতুন স্পেসিস আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করেন। তিনি এ ধারণা পেয়েছিলেন হালুদারের চিত্রকর্ম থেকে। যেন কোনো গুপ্তধন খুঁজে পেলেন মালিনী রায়। তিনি আরো খোঁজাখুঁজি করেন সে সময়ের সাময়িকী ও জার্নাল। হতাশ হতে হয়নি তাকে। কারণ ১৮১৯ সালে জার্মান প্রকৃতিবিজ্ঞানী লরেঞ্জ ওকেন সম্বার হরিণের কথা বলতে গিয়ে হালুদারের ছবির কথা বলেছেন। ১৮০৮ সালে আঁকা সে সম্বার হরিণটি রাখা হয়েছিল লিডেনহল স্ট্রিটে অবস্থিত কোম্পানির লাইব্রেরিতে। বর্তমানে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে শোভা পাচ্ছে সব মিলিয়ে হালুদারের ২৮টি চিত্রকর্ম। সেগুলো আঁকা হয়েছিল ১৭৯৫-১৮১৮ সালের মধ্যে।

সার্জন ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিলটন ছিলেন একজন স্কটিশ সার্জন, উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও ভূগোলবিদ। তিনি ১৭৯৪ থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে বাংলায় নিযুক্ত ছিলেন। দীর্ঘ এ সময়ে তিনি নথিবদ্ধ করছেন এখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রজাতিগুলো। সে সূত্র ধরেই তার সঙ্গে হালুদারের যোগাযোগ। ঐতিহাসিক ও লেখক মিলদ্রেদ আর্চার মনে করেন, হালুদার কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুপারিনটেনডেন্ট উইলিয়াম রোক্সবার্গের নিয়োগ দেয়া কয়েকজন চিত্রশিল্পীর একজন। রোক্সবার্গের সঙ্গে বুকাননের যোগাযোগ ছিল গভীর। তার মাধ্যমেই হালুদার বুকাননের অধীনে কাজ করেন। বুকানন দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর অঞ্চলে ১৭৯৮ সাল পর্যন্ত কোম্পানির হয়ে কাজ করেছেন। পাশাপাশি পার করেছেন পড়াশোনায়। তার ভাষ্য অনুযায়ী, সেখানে তিনি একজন বাঙালি চিত্রকর নিয়োগ দেন। সে বাঙালি তরুণ সম্ভবত হালুদারই ছিলেন। হালুদার বিস্ময়কর সূক্ষ্মতা নিয়ে এঁকেছেন বিভিন্ন প্রাণী।

লক্ষ্মীপুর থেকে বুকানন চট্টগ্রামে যান। সেখান থেকে কোম্পানির হয়ে জরিপের জন্য যান মহীশুর ও নেপাল। ১৭৯৮-১৮০৩ সালের এ সময়টুকু হালুদার তার সঙ্গে ছিলেন কিনা স্পষ্ট করে বলা যায় না। খুব সম্ভবত তিনি কলকাতা ফিরে এসেছিলেন ১৭৯৯ সালে। সে সময় চিকিৎসার জন্য রোক্সবার্গ কেইপ অব গুড হোপে চলে যান। বুকানন নেপাল থেকে কলকাতায় এসে ১৮০৩ সালে তার দায়িত্ব নেন। লর্ড ওয়েলেসলি তাকে ব্যারাকপুরের সার্জন নিযুক্ত করেন। সেখানে থাকা অবস্থায় বুকাননের অধীনে যে কয়জন চিত্রশিল্পী ছিলেন, তাদের মধ্যে হালুদার ছিলেন একজন। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় ব্যারাকপুর থেকে লন্ডনে দুই ধাপে আসা কিছু চিত্রকর্মের সূত্রে। প্রথম ধাপ গিয়েছিল ছিল ১৮০৭ সাল ও দ্বিতীয় ধাপ ১৮১৮ সালে। প্রথম ধাপে যাওয়া ডকুমেন্টে লেখা ছিল, ‘‌‌ড্রয়িংস অব ইস্ট ইন্ডিয়ান কোয়াড্রাপেডস অ্যান্ড বার্ডস মেড আন্ডার দি ইন্সপেকশন সেভারেলি অব মি. গিবন অ্যান্ড অব ড. ফ্লেমিং অ্যান্ড বুকানন-অ্যান্ড ডেপোজিটেড ইন দ্য লাইব্রেরি অব দি অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। সেখানে ২৬টি স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ২৮টি পাখির চিত্রকর্ম ছিল, যার ২৬টি চিত্রকর্মই এঁকেছেন হালুদার। তার সৃষ্টিকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপই ভারতের স্থানীয় স্বাদু পানির কার্পজাতীয় মাছের একটি গণ নাম হালুদারিয়া, যা তার নাম থেকে এসেছে। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে কোম্পানি আমলের আরো কয়েকজনের চিত্রকর্ম রয়েছে। তাদের মধ্যে হালুদারের সমসাময়িক চট্টগ্রামের গুরু দয়াল, মহনগু লাল ও বিষ্ণু প্রসাদ উল্লেখযোগ্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন