বিআইডিএসের সেমিনারে গবেষণার ফল উপস্থাপন

সরকারি খাতের বেতন বৃদ্ধি সাময়িকভাবে দারিদ্র্য বাড়িয়েছিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

২০১৫ সালে দেশের সরকারি কর্মচারীদের শতভাগ বেতন বৃদ্ধির প্রভাবে বেসরকারি খাতের স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন অনেক কর্মী সাময়িকভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গিয়েছিলেন। তখন শ্রমবাজারে নতুন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার সঙ্গে বেসরকারি খাতের স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরা মানিয়ে নিতে পারেননি। ফলে দক্ষ কর্মীর বেতন বাড়লেও বাড়তি বাজারমূল্যের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি কম দক্ষতাসম্পন্ন বেসরকারি কর্মীরা। 

গতকাল বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) শীতকালীন অর্থনৈতিক সম্মেলনে এ বিষয়ে প্রাথমিক গবেষণার ফল তুলে ধরেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) অর্থনীতিবিদ মো. আল-হাসান। এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ কে এনামুল হক। এর আগে সকালে উদ্বোধনী সেশনে কথা বলেন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্যামল চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অতনু রাব্বানি প্রমুখ। 

সেমিনারে উপস্থাপনা তুলে ধরে ইফপ্রির গবেষক মো. আল-হাসান বলেন, ‘মজুরি বেড়ে গেলে দারিদ্র্যসীমাও বেড়ে যায়। অর্থাৎ আগে যে আয় করলে মানুষকে দরিদ্র বলা হতো না, তার সীমা বেড়ে যায়। কিন্তু সবার মজুরি একই হারে বাড়ে না।’ সেজন্য এ সীমা ১০ শতাংশ বেড়ে গেলে দারিদ্র্য ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায় বলে উপস্থাপনায় দেখান গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইফপ্রির এ অর্থনীতিবিদ। 

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যখন জাতীয় বাজেট প্রস্তাব করা হয় এবং সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব আসে, তখন সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য বেশ দ্রুততার সঙ্গে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।’ দুইভাবে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায় বলে দেখান গবেষক। প্রথমত, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ছে—এমন খবর আসামাত্র দ্রুতগতিতে বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, বেতন বৃদ্ধির খবরের সঙ্গে যদি বাজেট প্রস্তাবের সময় চলে আসে, তাহলে পণ্যমূল্য আরো বেড়ে যায়। তবে এ গবেষণার ফল এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে বলে জানান গবেষক।

মো. আল-হাসান বলেন, ‘২০১০ থেকে ২০১৬-১৭ সালের মধ্যে দেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে দক্ষ কর্মীদের মজুরি বেড়েছে ৯০ শতাংশ থেকে ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত। আর মধ্যম মানের কর্মীদের বেতন বেড়েছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ। এর বিপরীতে দেশের সরকারি কর্মচারীদের মজুরি একই সময়ে বেড়েছে ১৩০-১৫৫ শতাংশ।’

উপস্থাপনায় বলা হয়, বাজারে উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের সরবরাহ কম থাকায় তারা নিজেদের মজুরি বাড়িয়ে নিতে পারেন, কিন্তু স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী বেশি থাকায় তাদের মজুরি তেমন একটা বাড়ে না। ফলে সরকারি ও দক্ষ বেসরকারি শ্রমিকের তুলনায় স্বল্প দক্ষ বেসরকারি কর্মীরা দরিদ্র হয়ে পড়েন। 

মুক্ত আলোচনায় বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ওয়ার্কার বা শ্রমিক বলতে কারখানার কর্মীদের বোঝানো হয়। কিন্তু যারা প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনাগত কাজে জড়িত, তাদের বোঝানো হয় না। এ গবেষণায় যদি বেতনভুক্ত সব কর্মীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে বিষয়টি গবেষণার জন্য যথাযথ হয়নি।’

সবাইকে এক কাতারে তুলনা করা যায় না বলে তিনি মত দেন। তিনি মনে করেন, খাত ও কাজের ধরন অনুসারে তুলনা করা উচিত।

জবাবে গবেষক মো. আল-হাসান বলেন, ‘এ গবেষণায় সব ধরনের কর্মীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাদের মজুরি ২০১০-১৭ সালের মধ্যে বেড়েছে। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্মী বা কারখানার শ্রমিকদের আলাদা করা হয়নি।’ তবে দারিদ্র্য বাড়ার বিষয়টি সাময়িক বলে উল্লেখ করেন তিনি।

দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘দুর্নীতি ও প্রণোদনা’ শীর্ষক উপস্থাপনা তুলে ধরেন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফাহাদ খলিল। এ সেশনে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।

অধ্যাপক ফাহাদ খলিল বলেন, ‘সমাজে এক্সটোরশন বা জবরদস্তিমূলক অনাচারের চেয়ে ঘুষ লেনদেন অপেক্ষাকৃত ভালো। কারণ হিসেবে বলা হয়, ঘুষ দিয়ে সেবা পাওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু অনাচার বিদ্যমান থাকলে টাকা দিয়েও সেবা মিলবে না। তদুপরি সরকার যদি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নজরদারি করতে গিয়ে কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা করে তাহলে তা উল্টো ফল দিতে পারে। কারণ তখন তৃতীয় পক্ষের লোকরা প্রণোদনা পাওয়ার জন্য উদ্দেশ্যমূলক ভুল প্রতিবেদন দিতে পারে। তাই অতিরিক্ত প্রণোদনা এক্ষেত্রে অনাচার তৈরি করতে পারে। আর এমন সমাজে যারা সৎ থাকেন তারা পরিস্থিতির কারণে পেশা বদল করতে বাধ্য হন। ফলে মেধার ভুল বিন্যাস হয়। ’

বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড. বিনায়ক সেন বলেন, ‘কোনো কাজের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালী কেউ চাঁদা নিয়ে যাচ্ছে হয়তো, কিন্তু সে ব্যক্তি কাজটির সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত নয়।’

তিনি বলেন, ‘অনেকে ঘুষ দিয়েও সেবা পায় না। এসব সমস্যা নিরসনে অবশ্যই একটি সিস্টেম থাকা দরকার।’

এ সময় রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে আদায়কারী কর্মকর্তাদের প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি করা যায় কিনা সেটির পরীক্ষা করে দেখা যায় বলে মন্তব্য করেন ড. বিনায়ক সেন।

এ সম্মেলন বিআইডিএস, বাংলাদেশ ইকোনমিক রিসার্চ নেটওয়ার্ক ও অ্যাসোসিয়েশন ফর ইকোনমিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস অন বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন