আত্মপ্রতিকৃতিতে অমৃতা শেরগিল

মুহম্মদ আল মুখতাফি

প্রতিটা চিত্রকর্মই নাকি তার স্রষ্টার আত্মপ্রতিকৃতি। তুলির আঁচড়ে জীবনকে চিত্রিত করা যাদের কাজ, তারা নিজের অভিজ্ঞতা ও স্বপ্নকেই হাজির করে। ‘‌আত্মপ্রতিকৃতি’ নামীয় চিত্রকর্মগুলোয় সে হাজিরা আরো তীব্র। সেদিক থেকে দেখলে অমৃতা শেরগিলের আত্মপ্রতিকৃতিগুলো যেন তার মনোজগতের টানাপড়েনের দর্পন। ইউরোপীয় অভিজ্ঞতা, ভারতীয় শেকড় এবং নারী পরিচয় মিলিত হয়েছে অদ্ভুত দ্যোতনা নিয়ে। সৃষ্টিকর্মের অনুপাতে হয়তো আত্মপ্রতিকৃতি নামীয় কর্ম বেশ কমই। স্বল্পায়ু জীবনে আঁকা ১৭২টি চিত্রকর্মের মধ্যে ১৯টি আত্মপ্রতিকৃতি বিভিন্ন সময়ে আলোচনা কুড়িয়েছে। আত্মপ্রতিকৃতির একটা সিরিজ শুরু করেছিলেন তিনি, যা সেলফ পোর্ট্রেট-১ থেকে শুরু করে সেলফ পোর্ট্রেট-৯ পর্যন্ত বিস্তৃত। এর বাইরেও বিভিন্ন সময় বিশেষভাবেই এঁকেছেন। কখনো পশ্চিমা আধুনিক পোশাকে আবার কখনো ভারতীয় পরিচ্ছদে। তবে সবসময়ই অন্তর্মুখী ও অস্থির চিত্তের এক নারীর চরিত্রকে তুলে এনেছেন তিনি। ভারতের সঙ্গে ইউরোপের মিশেল ঘটাতেই চাননি কেবল, মেলাতে চেয়েছেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতাকে; মনোজগতের সদর ও অন্দরকে।

হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ১৯১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন অমৃতা শেরগিল। মা ম্যারি অ্যান্টোইনিট গটেসম্যান অপেরায় গান গাইতেন। ধর্মের দিক থেকে তিনি একজন হাঙ্গেরীয় ইহুদি ছিলেন। অন্যদিকে তার পিতা উমরাও সিং শেরগিল ছিলেন ভারতীয় শিখ। এ বিচিত্র পরিচয় ও বেড়ে ওঠার গল্প অনেকখানি প্রভাব ফেলেছে নিজের বিশ্ববীক্ষা তৈরিতে। তিনি যেন নিয়ত কোনো দ্বৈত জগতের মধ্যে বসবাস করতেন এবং প্রায়ই নিজের আসল পরিচয় খুঁজে বেড়াতেন। মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকেই তিনি আত্মপ্রতিকৃতি আঁকা শুরু করে দেন। তার পর থেকে সময়ের সঙ্গে বেড়েছে দক্ষতা। অভিজ্ঞতা রূপান্তর হয়েছে শিল্পে। যুগান্তকারী পরিবর্তন প্রচেষ্টা এবং নারীত্বের নয়া প্রকাশের কারণেই ভারতের ফ্রিদা কাহলো হিসেবে পরিচিতি পান শেরগিল। তার উল্লেখযোগ্য একটি কাজ ‘সেলফ পোর্ট্রেট অ্যাজ আ তাহিতিয়ান’। আত্মপ্রতিকৃতিটিতে তাকে দেখা যায় একজন তাহিতিয়ান নারীর বেশে। এমন সাহসী সৃষ্টি সে সময় বেশ সমালোচনা তৈরি করে ভারতীয় সমাজে। তার ওপরে সেটা একজন নারী শিল্পী দ্বারা আঁকা। তবে ভালোভাবে তাকালে আত্মপ্রতিকৃতিতে ইউরোপীয় চিত্রশিল্পী পল গগ্যাঁর ছাপ পাওয়া যায়। পল সেজান ও পল গগ্যাঁর দ্বারা দীর্ঘদিন অনুপ্রাণিত ছিলেন শেরগিল।

একাকিত্বকে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতেন, যেন রঙ-তুলিতে নিজের বিষণ্নতার আঁচড়ই কেটে চলছেন। তার আঁকা এসব চিত্রকর্ম বেশ আলোড়ন ফেলেছিল চারদিকে। সে সময়ে ভারতীয় সংস্কৃতিতে বেশির ভাগ চিত্রে নারীদের হাসি-খুশি ও সংসারমুখী চরিত্র তুলে ধরা হতো। তিনি নারীর অভ্যন্তরীণ বিষয়াবলিকে বানিয়ে তুললেন চিত্রকর্মের আলোচ্য বিষয়। তার আরো একটা নজির পাওয়া যায় আত্মপ্রতিকৃতিতে। ছোট চুল ও পশ্চিমা পোশাকে শেরগিল যেন মিশে গেছেন ফরাসি সংস্কৃতির সঙ্গে। তবে তার দ্বিধাগ্রস্ত হৃদয়ের চিত্র উঠে এসেছে ফ্রান্সে থাকা অবস্থায় আঁকা নামহীন আত্মপ্রতিকৃতিতে। তিনি সেখানে হলুদ রঙের ফ্রেঞ্চ হ্যাট পরিহিত অবস্থায়। সামনে একটি ছাইদানি। অমনোযোগী অবস্থায় দূরে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। যেন সম্মুখকে অবজ্ঞা করে নতুন কিছু তালাশ করছেন। তিনি কি যাপিত জীবন থেকে বিমুখ হয়ে নতুন পরিচয়ের সন্ধানে ছিলেন তখন? আর সে পরিচয় তুলে নিয়েই কখনো লাল আবার কখনো নীল শাড়ি হয়ে উঠেছে তার পরিধেয়। হাতে ও গলার অলংকারে ভারতীয় পরিচয়ের স্বাক্ষর। 

মাত্র ২৮ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তার ১৭২টি চিত্রকর্মকেই ভারত সরকার জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। তার আত্মপ্রতিকৃতিগুলো যেন তার আত্মজীবনী হয়েই সময়কে বন্দি করে রেখেছে তুলির আঁচড়ে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন