বহুমাত্রিক সারল্যে হিমদশা

ওয়াহিদ সুজন

নিজের সাম্প্রতিক প্রদর্শনী নিয়ে মোর্শেদ জাহাঙ্গীরের মন্তব্য, ‘আমি একজন দৃশ্যশিল্পী। চিত্রকলায় আমার কাজের বিষয়বস্তুগুলি আমার চারপাশে একধরনের প্রতিবিম্বের ফলাফল। আমি ভাস্কর্য, ইনস্টলেশন, অঙ্কন, ভিডিও, শব্দ এবং ডিজিটাল সরঞ্জাম ইত্যাদি মাধ্যমে কাজ করি। মিডিয়া এবং মাধ্যমের প্রতি আমার মনস্তাত্ত্বিক, আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক মনোভাব রয়েছে। এবং এক রকম, আমার কাজগুলি বাস্তবতার খুব সংক্ষিপ্তসার, মানুষের উপলব্ধি এবং সমাজের ধারার সাথে সম্পর্কিত। আমি পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়ায় উৎসাহ বোধ করি।’

রাজধানীর লালমাটিয়ার কলাকেন্দ্রে চলমান ‘±২০/হিমদশা’ প্রদর্শনীতে প্রবেশের আগ মুহূর্তে দেয়ালে টাঙানো শিল্পীর এ মন্তব্য থেকে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু ধারণা ও তার ভাষিক দূরত্ব যে প্রায় দুর্লঙ্ঘ্য তা টের পেতে বেশি দেরি হয় না। এবং জীবন স্রেফ আমি বা আমরা; এখানে সীমাবদ্ধ নয়। দেখার সীমানা তাকে নানাভাবে ডিফাইন করে। যার কিছু গায়েব থেকে যায়। যেমন কিছু দৃশ্যের ভেতর নিজের থাকাটা দেখার উপযুক্ত হয়ে উঠিনি আমরা। সেটা হয়তো আলোকবর্ষ দূরত্বের কারণে, আবার কিছু বিষয় এত কাছে যে দৃষ্টি তার দেখা পায় না। আমি যে প্রক্রিয়ার ভেতর উপস্থিত তাকেও দেখা যায় না। কিন্তু দেখা এ অর্থে অর্থবোধক হয় না সবসময়। যেমনটা মোর্শেদ জাহাঙ্গীরের ‘মনস্তাত্ত্বিক, আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক’ দেখা প্রসঙ্গে প্রযোজ্য। সম্ভবত শিল্পীর দেখাকে আমরা এভাবে ব্যাখ্যা করব। মানে এমনটা ভাবলে আমাদের জন্য সহজ হয়।

শৈল্পিক মন তো মানুষের পূর্বগামী নয়। আমরা যখন মানুষ বলি, যা সাধারণভাবেই অভিব্যক্তিময় মানুষ। সেই অভিব্যক্তিকে ভাষার জগতে অনেক বেশি যৌক্তিক আকারে চলাচল করতে হয়। কেউ কেউ বলবেন, একে গাণিতিক বা জ্যামিতিক ফর্মে উপস্থাপন করা যায়। ব্যাকরণ তো আছেই। কিন্তু অভিব্যক্তি মাত্রই এমন নয়, বরং তাকে ধারণ করার পাত্রের ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু। 

অভিব্যক্তিময় মানুষটি এমন নয় যে একটা স্থানকালের ঘেরাটোপে আটকে থাকে। সে বহন করে চলে ধর্ম-মিথ-ইতিহাস-বিজ্ঞান ও মানুষের সমূহ প্রবহমানতা। সেখানে যেমন থাকে নন্দনকানন থেকে বিচ্যুত মানুষ, মহাপ্লাবনে টিকে যাওয়া মানুষ, অথবা বরফযুগ পার করে আসা মানুষ। বনচারী থেকে দালানকোঠা গড়ে তোলা মানুষ। বৃত্ত বা শূন্যের ধারণা পাওয়া মানুষ। ফলত মানুষ এমনই এক সত্তা, তার প্রকাশ যতই যৌক্তিক রূপ নিক না কেন, তার গড়ে ওঠার এত এত অপ্রকাশ্য রূপ যা তাকে নাই করে দেয়।

সে বিষয়টিকে আমরা আসলে কীভাবে ব্যাখ্যা করব। সম্ভবত সেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায় ‘ ২০/হিমদশা’।  এই বিশ্ব যেমন নানান আকার-প্রকাশের জটিল সন্নিবেশ, তেমনি মাধ্যম হিসেবে বিবিধের আশ্রয় নেন শিল্পী মোর্শেদ। প্রদর্শনীর একদম শুরুতেই দেখা যায়, ছাদের সঙ্গে জুড়ে দেয়া সুতোয় বাঁধা একটি কাপড় লম্বালম্বিভাবে ফ্যানের হাওয়ায় দোল খাচ্ছে, যার সঙ্গে বাঁধা কলম নিচে রাখা কাগজে নিজের মতো করে দাগ কাটছে। নিশ্চিত পরিকল্পিত ঘটনা। কিন্তু কাগজে কতটা দাগ কীভাবে ফুটবে তা কি পরিকল্পনা করা যায়! কিছু সীমানা হয়তো অনুমান করা যায়। সেই অনুমানের ভেতরে কতটা বিন্দু সাঁতার কাটছে ও কী রূপ নেবে আমরা জানি না। আপাতভাবে সাদামাটা মনে হলেও অ্যালান বার্গসোঁর ‘সৃজনশীল বিবর্তনের’ কথাই মনে পড়ল। যেভাবে জগৎ নিয়ত সৃজনশীল পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যায়। তৈরি হয় ভবিষ্যৎ। এভাবে আমরা যতটা দৃশ্যের ভেতর এগোতে থাকি, শিল্পীর জটিল জগতে প্রবেশ করি। প্রতিটি বস্তু আলাদাভাবে সহজ বলে মনে হয়। কখনো কখনো শিশুর সারল্য দেখি। ইচ্ছামতো আঁকিবুঁকি। ঠিক যেমন শুরুতে উড়তে থাকা কাপড়, কলম ও কাগজের জোড়বন্ধন। কিন্তু তাদের যোগ আসলে কী? 

মোর্শেদ জাহাঙ্গীর দুনিয়ার যে ছাপ এঁকেছেন, তা মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটিয়ে তোলে। কখনো কখনো দেখা যাচ্ছে, কোমল-নরম ফোমের অবয়বকে বিদ্ধ করে বের হয়ে এসেছে লোহার রড। আবার একটি ছবিতে দেখা যায় প্লেটের ওপর সাজানো আছে আপেল ও ছুরি। ওই প্লেট যেন মানুষের শরীর আর আপেলটা মানুষের হৃদয়। বাকিটুকু কল্পনা করে নিন না; কী বলছে। কারখানা শাসিত এ সময়ে মানুষ কীভাবে ক্ষতবিক্ষত ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে প্রদর্শনীর পরতে পরতে আছে সেই দাগ। 

‘±২০/হিমদশা’র কিউরেটর শার্মিলি রহমান। তিনি বলছেন, ‘সময় পরিগ্রহের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এই তিন দশা যেখানে একটি একক ব্লকের মাঝে আবদ্ধ তার এক একটি অনুপল মুহূর্তের অংশী কোনো ব্যক্তি-মানুষ একই সঙ্গে অবস্থান করছে বিবিধ ভূরাজনৈতিক পরিসরে। এমনটাই হাল আমলের হকিকত, ব্যক্তি-মানুষের স্বগত সংলাপ ও নিজস্ব যুক্তির অতলান্ত তথ্য সমুদ্রে তার বুনিয়াদ, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তিসত্তাই একই সাথে নির্মাতা এবং ভোক্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অনিয়ত, অজস্র মিডিয়া কনটেন্টের মধ্যকার বিক্ষিপ্ত সম্পর্কের বুনটই সাম্প্রতিক সময়ের এমন এক সাংস্কৃতিক চর্যার ভঙ্গি ও ভাবকে ধারণ করে।’

আরো বলছেন, ‘সময়, পরিসর, মনন, মাধ্যমের আন্তর্ব্যাপী সংলাপের বুনটে অজস্র উপাদানের মধ্যকার কোলাহল কিংবা নৃত্য-ছন্দের গমকে শিল্পী জাহাঙ্গীরের শিল্পকর্মগুলো উচ্চারণ করে তার ধ্যানস্থ মগ্নতার অনুভব। শিল্পী যেন অনেকটাই তার অবিন্যস্ত কাণ্ডজ্ঞানের রূপ দেন কোনো অন্তর্ঘাতী অথবা আন্তঃব্যক্তিক সংঘাতের ঠাটে প্ররোচিত হয়ে; এই দুনিয়াবির অসাম্য, ভূরাজনৈতিক নাট্যলীলার মাঝে, লঘু বা প্রায় সম্বন্ধহীন চ্যুত অর্থের বহুবিধ প্রকরণের সংমিশ্রণ কিংবা সংস্থাপন এ আয়োজনে। ফলে এই প্রকাশের অনুরণনে ধরা পড়ে তার আপাত অসংগত অভিব্যক্তি, কিন্তু একই সাথে সূক্ষ্ম ক্রিটিক্যাল বোঝাপড়ার মুন্সিয়ানা। শিল্পীর এ কাজগুলো উপস্থাপনের ঢঙ কম-বেশি কিছুটা অপ্রথাসিদ্ধ, অন্তর্লেখ বস্তু—মননের নিরীক্ষাকেই সমর্থন করে।’

শিল্পী ও কিউরেটরের ভূমিকাটুকু আমাদের জানান দেয়, এ প্রদর্শনীর গূঢ় লক্ষ্যের দিকে। একই সঙ্গে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ‘±২০/হিমদশা’ ভীষণভাবে সময় ও সভ্যতা সচেতন প্রয়াস। যেখানে বিশৃঙ্খল একটা জগৎকে আমরা প্রতিস্থাপন করতে পারি, আমাদের ‘কথিত’ সাজানো গোছানো কাঠামোবদ্ধ-যৌক্তিক এ ভূবিশ্বে। কিন্তু সে কতটাই-বা বিধিবদ্ধ থাকতে দেয়। ছেলেমানুষির ছলেও যার অন্তর্নিহিত ছলনাগুলো ধরতে পারেনি। উল্টো কৌতুক করে সান্ত্বনা পাই। কিন্তু এ জগতের কিছু শর্ত; কঠিন-কোমল-তরল-বায়বীয়, কোণ-ত্রিকোণ-গোল-বক্ররেখা তার বাইরে আমরা যেতে পারি না। সেই শর্তের মাঝে হিমদশা মানুষ আক্রান্ত হয় কিনা জানি না। বরং মানুষ ক্রমশ শর্তাধীন পরিস্থিতি ভেঙে নতুন নতুন কিছু গড়ে। দেখা বা দেখানোর প্রথম শর্তই ‘মানুষ’। যখন অভিব্যক্তির শৈল্পিক রূপ দেখি, মূলত সেই মানুষটাকেই খুঁজি, যে সব ধারণারই পূর্বগামী। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন