রব গনজালভেসের জাদুবাস্তবতার দুনিয়া

ওয়াটার ড্যান্সিং (ডানে) ও পুলিং স্ট্রিংস (বামে)

‘‌স্বপ্নবিলাস ও আঁকাআঁকিতে ভরা একটা শৈশব বিবর্তিত হয়েছে চিত্র নির্মাণের পেশায়। এ যেন নিজের কল্পনাগুলোকে উদযাপন করা।’ 

নিজের শিল্পকর্মকে এভাবেই বিচার করেছেন রব গনজালভেস। শিল্পকে তিনি নিয়ে গেছেন অন্য মাত্রায়। এমন এক স্বতন্ত্র পৃথিবী তৈরি করেছেন, যেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে বাস্তবতা আর শিল্পীর নিজস্ব কল্পনা। ঝরনা রূপ নিয়েছে নৃত্যরত নারীর। সিঁড়ি উঠে গেছে মহাবিশ্বকে ছাপিয়ে। দোলনায় দুলতে থাকা শিশু যেন গোটা ‍পৃথিবীকেই নিচে ফেলে দুলছে। যেন ভেঙে পড়ে গেছে সম্ভব আর অসম্ভবের দেয়াল।

রব গনজালভেস ১৯৫৯ সালের ২৫ জুন কানাডার টরন্টোতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা এলেন গনজালভেস ও মা রুথ গনজালভেস। দুই সন্তানের মধ্যে রব ছিলেন দ্বিতীয়। শৈশব থেকেই শিল্পের প্রতি ছিল টান। সবসময় তাকে পাওয়া যেত নিজের রুমে কিংবা বাসারই কোনো এক কোণে। চুপচাপ বসে আঁকাআঁকি করতেন। মাত্র ১২ বছর বয়স থেকেই স্থাপত্যের প্রতি তার আগ্রহের প্রমাণ মেলে। অন্টারিও কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ডিজাইনে রব পড়াশোনা করেন। তারপর সেখান থেকে চলে যান রায়ারসন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিদ্যায় পড়াশোনার জন্য। দুই বছর স্থপতি হিসেবে কাজও করেছেন তিনি। কিন্তু ১৯৯০ সালে টরন্টোতে চিত্র প্রদর্শনীতে যাওয়ার পর যেন জীবন ভিন্ন দিকে বাঁক নিল। চিত্রকর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহ তাকে পুরোদমে ব্যস্ত বানাল আঁকার কাজে। সফলতাও ধরা দেয় দ্রুত। নিউইয়র্ক ও লস অ্যাঞ্জেলসে তার চিত্র প্রদর্শনী হয়। শিল্পবোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দেরি হয়নি। একের পর এক প্রদর্শনী হয় ডেকোর আটলান্টা, লাস ভেগাস, ফাইন আর্ট ফোরামসহ অন্যান্য স্থানে ও প্রতিষ্ঠানে। হাকলবেরি ফাইন আর্ট তাকে নিয়ে প্রকাশনাও বের করে। ২০০৩ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ের প্রচ্ছদ তার শিল্পখ্যাতিকে পাকাপোক্ত করে। বইটির নাম Masters of Deception: Escher, Dali and the Artists of Optical Illusion। একই বছর জুনে তার ১৬টি চিত্রকর্ম নিয়ে “Imagine a Night” নামে বই বের হয়। মূল বইটি সারাহ এল থমসনের হলেও চিত্রকর্মগুলো ছিল রবের। ঠিক পরের বছর বের হয় Imagine a Day, যা শিশুসাহিত্য বিভাগে ‘Governor General’s Award’ লাভ করে ২০০৫ সালে। তার অন্য দুটি বই যথাক্রমে Imagine a Place ও Imagine a World।

রবের বয়স যখন ত্রিশের দিকে, তখন পরিচয় ঘটে জনপ্রিয় পরাবাস্তব শিল্পীদের সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে। পরবর্তী জীবনে তাকেও আচ্ছন্ন করে রাখে ‍আঁকার এ ধারা। তবে তার আঁকাআঁকিকে পরাবাস্তব না বলে জাদুবাস্তব বলাই বেশি যৌক্তিক। কারণ তিনি অবচেতন মনকে বিমুক্ত করার চেয়ে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে জাদু ও বাস্তবকে একত্রিত করাতে দৃঢ় ছিলেন। তার কাজ ছিল মানুষের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে উপস্থাপন করা। অসম্ভবকে সম্ভাবনার সীমানায় নামিয়ে আনা। তার কাছে জাদু জীবনের আবশ্যকীয় অংশ। মানুষকে তা মেনে নেয়ার মতো হয়ে উঠতে হবে। শুধু তখনই কেউ চিত্রগুলো তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারবে। বাস্তবিকভাবেই রব সেটাই করছিলেন। জীবনের বাঁক থেকে কুড়িয়ে পাওয়া নানা অভিজ্ঞতা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন জাদুময় পৃথিবীকে। রবের মতে, শিল্পে মায়া মানে প্রতারণা না। বরং জাদুময় পৃথিবী তৈরি করার একটা অস্ত্র হলো শিল্প। চিত্রে ত্রিমাত্রিকতা আনার প্রচেষ্টায়ই স্থির থাকেননি। বিষয়বস্তু ও চিন্তার পটভূমির জন্য নিজে নির্ধারণ করেছেন, তার কী প্রয়োজন। এজন্য প্রচুর খসড়া স্কেচ আঁকতে হয়েছে। রবের দাবি অনুযায়ী, তিনি তার ৬০ শতাংশ সময় ব্যয় করেছেন কেবল প্রস্তুতিপর্বে।

রব তার শিখে আসা গণিত ও স্থাপত্য জ্ঞান চিত্রকর্মেও প্রয়োগ করতে থাকেন। এক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করে রেঁনে ম্যাগ্রিতের সৃষ্টিকর্ম। মাঝে মাঝে রব জীবনের দ্বৈততা থেকেও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন আঁকার। মানুষ বনাম প্রকৃতি, গ্রাম বনাম শহর, আধ্যাত্মিকতা বনাম পার্থিবতা, আলো বনাম অন্ধকারের মতো দ্বৈততাকে এঁকেছেন। একটি থেকে আরেকটিতে রূপান্তর ঘটানোর ক্ষেত্রে তার সৃজনশীলতা ছিল বিস্ময়কর। আরো অনেকদিন বাঁচতে পারতেন। উপহার দিতে পারতেন আরো অজস্র সৃষ্টিকর্ম। কিন্তু তা হয়নি। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ২০১৭ সালের ১৪ জুন আত্মহত্যা করেন রব গনজালভেস।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন