পোশাক পণ্যের বৈশ্বিক জায়ান্ট জারাকে আমন্ত্রণ

পশ্চিমবঙ্গকে গার্মেন্ট হাব বানাতে চায় মমতা ব্যানার্জি

বদরুল আলম

বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড জারা। এর মালিকানায় রয়েছে স্প্যানিশ কোম্পানি ইন্ডিটেক্স। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটে বহুজাতিক এ জায়ান্টের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি পিইউ কারখানা স্থাপনের আলোচনার সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে এর ধারাবাহিকতায় চলতি মাসে জারা’র সঙ্গে বৈঠক করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। বৈঠকে বহুজাতিক এ জায়ান্টকে জমি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। চলতি বছরের বড়দিনের আগেই উৎপাদন শুরু হবে বলে আশা মুখ্যমন্ত্রীর। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে পোশাক খাত কেন্দ্রিক নতুন ম্যানুফ্যাকচারিং হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যেই স্পেন সফরে ইন্ডিটেক্সকে এ প্রস্তাব দিয়েছেন মমতা। খবরটি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদেরও। কেননা বিশ্ববাজারের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক কেনে ইন্ডিটেক্স।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, স্পেন সফরকালে গত ১৪ সেপ্টেম্বর মাদ্রিদে বহুজাতিক জারার সঙ্গে বৈঠক করেন মমতা ব্যানার্জি। পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে ওই বৈঠকে। স্পেনের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের কাছে তার রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনা তুলে ধরেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।   

বৈঠকের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (টুইটার) মমতা ব্যানার্জি এক বার্তা দেন। এক্স হ্যান্ডেলে তিনি লেখেন, ইন্ডিটেক্স পোশাক শিল্পের প্রথম সারির বস্ত্র বিপণি সংস্থা, যারা তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছে। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে তাদের উৎপাদন করতে চলেছে, যা চলতি বছরের বড়দিনের আগেই শুরু হবে। 

মমতা আরো জানান, মেগা প্রকল্পের সুবিধার্থে টেম্প ইন্ডিটেক্স গ্রুপ ও তাদের সহযোগী সংস্থাগুলোকে ১০০ একর জমি দেয়ারও কথাবার্তা চলছে, যাতে তারা পিইউ কারখানা তৈরি করতে পারে। এ বিনিয়োগের জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সব রকম সাহায্য করা হবে। আর এ উদ্যোগ পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ ও উন্নতির পক্ষে সহায়ক হবে বলেও উল্লেখ করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।

মমতা ব্যানার্জির সেই বার্তা নিয়ে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদেরও অনেকে ভাবতে শুরু করেছেন। পোশাক রফতানিকারক-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের প্রস্তাব ও ঘোষণাটি এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক। তবে বাস্তবায়ন হলেও বাংলাদেশের উদ্বেগের তেমন কারণ নেই। কেননা বাংলাদেশের সঙ্গে ইন্ডিটেক্সের সম্পর্ক একদিনে গড়ে ওঠেনি। আর পশ্চিমবঙ্গে নানা কারণে সুষ্ঠুভাবে শিল্প পরিচালনা বাংলাদেশের মতো এত সহজ নয়। সব মিলিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ক্রয়াদেশ কিছুটা কমলেও বড় ক্রয়াদেশ সরবরাহে সক্ষম বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠার বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। আর ইন্ডিটেক্স সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তাবটি একটি রাজনৈতিক ঘোষণা কেবল। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ যদি ভূরাজনৈতিক কোনো বিধিনিষেধের বেড়াজালে পড়ে যায় তখন প্রস্তাবটি ভারতের জন্য বড় ধরনের সফলতা হয়ে ধরা দিতে পারে। 

পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইন্ডিটেক্স যদি পশ্চিমবঙ্গে ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট করে, তাহলে তা বাংলাদেশের আসা ক্রয়াদেশের কিছুটা হয়তো নিতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশের সক্ষমতা অনেক বড়, সেই স্থানটি দখলে নেয়া সময়সাপেক্ষ বিষয়। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গে শিল্প পরিচালনায় নানা রকম প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কাজেই প্রস্তাব, সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন সব বিষয়ই বেশ সময়সাপেক্ষ। বড় ধরনের উদ্বেগের এখনই কারণ নেই।’

ইন্ডিটেক্স সূত্র জানিয়েছে, ইউরোপীয় ক্রেতারা তাদের সামর্থ্য ও চাহিদা অনুযায়ী কেনাকাটা করে। ১০ বছর আগে ইউরোপের বাজারে একটা শার্ট ন্যূনতম ৫০ ইউরোতে বিক্রি হতো। এখন সেই শার্ট বিক্রি হয় ১২-১৫ ইউরোতে। বিশ্বে অনেক পণ্যের দাম বাড়লেও পোশাকের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। বাংলাদেশ মূলত মৌলিক বা জনসাধারণের পোশাক তৈরি ও রফতানি করে। তাছাড়া পোশাক রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশে যে বাজার সৃষ্টি হয়েছে, এর পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্যোক্তা ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের উদ্যম অবশ্যই বড় বিষয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজার চাহিদার যে প্রবাহ এ দেশে এসেছে সেটা মূলত নিজ নিজ দেশের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের সুফল। তারা দেখে পণ্যটি পশ্চিমা বাজারগুলোয় ১২ টাকায় বিক্রি করতে হলে সেটা কোন স্থানে তৈরি করা লাভজনক হবে। বাংলাদেশে যদি আগামীকাল এমন কোনো পরিস্থিতি হয় যে উৎপাদন খরচ আর ইউরোপে বিক্রয়মূল্যের পার্থক্য মাত্র ২০ বা ৩০ শতাংশ, তাহলে অবধারিতভাবে পরবর্তী মৌসুমে দেশের ব্যবসা অর্ধেকে নেমে আসবে। কারণ দিন শেষে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকারের বিষয় হলো ব্যবসা।

বিশ্ব বাণিজ্য বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, মমতা ব্যানার্জির প্রস্তাবটা গেম চেঞ্জারের বিষয় হয়ে উঠতে পারে। কারণ বিশ্বরাজনীতিতে এখন বিভিন্ন ধরনের স্যাংশন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বৈশ্বিকভাবে ভূরাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে চীনকেও ব্যাকফুটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ভোক্তা পর্যায়ে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতাসক্ষম থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত কারো কিছু করার থাকবে না। তবে এ প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন আসতে পারে যদি যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ বাংলাদেশের ওপর কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশন দেয়। রাশিয়া কিংবা চীনের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে এ ধরনের ভূরাজনৈতিক কোনো বেড়াজালে বাংলাদেশ পড়ে গেলে তখন আর কিছু করার থাকবে না। তবে এমন কিছু যদি না ঘটে তাহলে মমতা ১০০ না, এক হাজার একর জমি দিলেও বাংলাদেশের কিছুই আসে-যায় না। 

বিশ্ব বাণিজ্য বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমা ক্রেতাদের ব্যবসা একদিনে গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন ধরে একটা গোটা সরবরাহ চেইন তৈরি হয়েছে। এ রকম একটা দীর্ঘমেয়াদি ও দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের মধ্যে যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের প্রস্তাবে কিছু ব্যবসা ভারতে যায়ও তা ১০ শতাংশের বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। এক লাখ পিসের ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে আসার কথা থাকলে হয়তো ১০ হাজার পিস কম আসবে। কোনোভাবেই পুরো ক্রয়াদেশ শুধু ভারতে যাবে না। কারণ সেটা ইন্ডিটেক্সের জন্য ঝুঁকিরও কারণ হতে পারে। বিশ্বব্যাপী এখন অর্থনীতি পরিচালিত হয় ভূরাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিকে কেন্দ্র করে।

ইন্ডিটেক্স সূত্র বণিক বার্তাকে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাব্যানার্জি একটি প্রস্তাব দিয়েছেন কেবল। কিন্তু এ মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না ইন্ডিটেক্স। বহুজাতিক এ সংস্থার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে জানান, নিকট ভবিষ্যতেও সে প্রস্তাব বাস্তবায়নের কোনো পরিকল্পনার তথ্য তাদের কাছে নেই।   

জারাকে দেয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের প্রস্তাব নিয়ে এখনই ভাবনার কিছু নেই জানিয়ে পোশাক রফতানিকারকদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি সেলিম ওসমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এর ‌কোনো প্রভাব আছে, এমনটা আমি মনে করি না। কারণ আমাদের শ্রম, পণ্যের মান। সব মিলিয়ে আমাদের মতো সক্ষমতায় পৌঁছাতে আরো ৫০ বছর সময় লাগবে। যেকোনো প্রেক্ষাপটেই এ ধরনের কোনো পদক্ষেপে সফলতা আসবে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের সফলতা দীর্ঘ সময়ের।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘১০০ একর কেন ১০ হাজার একর জমিও দেয়ার সক্ষমতা প্রতিবেশী দেশের আছে। তবে আমাদেরও যতগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠছে, সেগুলো যদি চালু হয়ে যায় তাহলে উৎপাদনমুখী শিল্পে বড় ধরনের রূপান্তরের সম্ভাবনা রয়েছে। আর আমাদের পোশাক কারখানার শ্রমিকদের আমরা বলি কারিগর, হাতের কাজে তাদের সক্ষমতা প্রকৃত অর্থেই ঈর্ষণীয়। পোশাকসংশ্লিষ্ট সব ধরনের পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ভারত থেকে কাঁচামাল এনেই বাংলাদেশ রফতানিতে বিশ্বে দ্বিতীয়। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন