ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন

রফতানি বাড়াতে বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও পণ্যের বৈচিত্র্যায়ণ প্রয়োজন

ডলারের বিপরীতে টাকার ধারাবাহিক অবমূল্যায়নের সুফল পাচ্ছে না রফতানি খাত। এক্ষেত্রে রিয়াল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট ইনডেক্স বা প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার সূচকের তুলনায় ডলার অতিমূল্যায়িত হয়েছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের। বস্তুত বর্তমান প্রেক্ষাপটে রফতানিকারকরা লাভবান হওয়ার কথা থাকলেও উৎপাদনসংশ্লিষ্ট অন্যান্য খরচ বৃদ্ধির ফলে সেটি হচ্ছে না বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন। কিন্তু টাকার অবমূল্যায়নের ফলে অনুকূল পরিবেশ থাকার পরও আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি কেন বৃদ্ধি পেল না, সে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে। কেননা টাকার অবমূল্যায়ন রফতানিকারকদের ডলারের বিপরীতে আরো বেশি অর্থ পেতে সহায়তা করে। বিদেশী ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পায়।

বণিক বার্তায় প্রকাশ, দেশে বর্তমানে ডলারের গড় বিনিময় হার ১০৮ টাকা ৪০ পয়সা। কিন্তু প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার সূচক এর চেয়ে কম—১০২ টাকা ১০ পয়সা। বস্তুত বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ধরে রাখার প্রবণতা দীর্ঘদিনের। আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নীতি অনুসরণ করে। ফলে দেশে ডলারের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার সূচকের সঙ্গে মুদ্রাবাজারে ডলারের গড় বিনিময় হারে সব সময়ই ব্যবধান দেখা গেছে। এদিকে গোটা বিশ্বেই এখন পরিস্থিতি একেবারেই বিপরীত। ইউরো, পাউন্ড, ইয়েনের বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার কমছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। কিন্তু বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এর সুবিধা বাংলাদেশের রফতানিকারকরা পাচ্ছেন না।

এজন্য প্রকৃতপক্ষে কোন কারণটি দায়ী সেটি অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। কেননা এরই মধ্যে বিদেশী ক্রেতাদের জনপ্রিয় গন্তব্যের তালিকায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে অন্য দেশগুলোর নাম উঠে আসছে। যে কারণে পরোক্ষভাবে রফতানিকারকরা সুবিধা পাচ্ছেন না। তাই রফতানির ক্ষেত্রে নতুন বাজার অনুসন্ধান জোরদার করা উচিত। এজন্য বিদেশী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্যায়ণের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজেদের মানও ধরে রাখতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ প্রডাক্ট যেন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হয়, সেক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। আর রফতানি বাজার ধরে রাখতে যথাযথ কূটনৈতিক তৎপরতা নিশ্চিতের বিকল্প নেই। 

এদিকে টাকার মূল্যমান নিয়ন্ত্রণের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন রফতানিকারকরা। এ কারণে বিভিন্ন সময় ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের দাবিও তোলা হয়। কিন্তু গত দুই অর্থবছরে টাকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অবমূল্যায়ন হলেও ব্যবসায়ীরা এর সুবিধা নিতে পারেননি। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিময় হারের সুবিধা মিলেছে ১৫-২০ শতাংশ। এক্ষেত্রে দেখা গেছে, ১০০ ডলার থেকে আনুষঙ্গিক বিভিন্ন খাত মিলিয়ে প্রায় ৮০ শতাংশ খরচ হয়। বাকি ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে মুদ্রা বিনিময় হারের সুবিধা পাওয়া যায়। গত এক-দেড় বছরে এ সুবিধা পেলেও আনুষঙ্গিক দ্রব্য বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়েছে। যে কারণে প্রকৃতপক্ষে ব্যবসায়ীরা ডলারের বিনিময় হারের সুবিধা পাননি। এর পাশাপাশি বর্ধিত হারে গ্যাস-বিদ্যুতের বিল প্রদান করায় ডলারের দাম বাড়ার সুবিধা অন্য খাতে ব্যয় হয়ে গেছে।

অর্থনীতিবিদরা রফতানি ও রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে সক্রিয় বিনিময় হার প্রয়োগের কথা বলছেন। কিন্তু গত দুই বছরে টাকার অবমূল্যায়ন সত্ত্বেও রফতানি ও রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে এখনো এর প্রভাব সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি। অর্থাৎ বিনিময় হার বাজারকে প্রভাবিত করতে পারছে না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রেও উভয় সংকট চলছে। একদিকে মূল্য পরিশোধে বিলম্ব হচ্ছে, অন্যদিকে রেমিট্যান্স আসা কমে গেছে।

পোশাক রফতানিকারকদের ভাষ্যমতে, রফতানির প্রচলিত স্বাভাবিক পদ্ধতিতে ডলারে পেমেন্ট আসে। সে ডলারেই রফতানিকারকের ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্রের দায় পরিশোধ হয়। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সময়মতো ক্রেতার কাছ থেকে পেমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না। পণ্য রফতানির পর যখন নথিপত্র জমা দেয়া হয়, ব্যাংক সেটা কিনে নেয়। আর তখনই বিপত্তি ঘটে, কারণ ব্যাক টু ব্যাকের দায় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার কিনতে হয় ১০৯ টাকা করে। তাতে প্রতি ডলারে ৬ থেকে ৮ টাকার ব্যবধান তৈরি হয়। ফলে রফতানিকারকদের সুবিধা আর থাকে না।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই টাকার বিনিময় হারে নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানের সমালোচনা করেছেন অর্থনীতিবিদরা। ২০১২ সালের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে আর বাজারভিত্তিক করে দেয়নি। এজন্য প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে আসার বদলে হুন্ডির বাজার বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নীতিকে দায়ী করা হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এখন সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই। কারণ ডলার সংকট যেমন কমছে না, তেমনি এর বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ক্ষেত্রে সুবিধাও পাচ্ছে না রফতানি খাত। কিন্তু প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলার খরচ করতেই হচ্ছে। এখন আমদানিকারকদের পাশাপাশি রফতানিকারকদের স্বার্থও বিবেচনা করতে হবে। এজন্য উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও মানসম্পন্ন পণ্য তৈরি করে রফতানি বাজার ধরে রাখতে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন