মুডি’সের পর বাংলাদেশের রেটিং নেতিবাচক করল এসঅ্যান্ডপি

বৈদেশিক বাণিজ্য ও রিজার্ভ আরো চাপে পড়বে

হাছান আদনান

মুডি’সের পর এবার বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং বা ঋণমান কমিয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির মূল্যায়ন অনুযায়ী, স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচক অবস্থায় নেমে এসেছে বাংলাদেশের ঋণমান। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং এখন ‘বিবি মাইনাস’ (BB-)। আর স্বল্পমেয়াদে রেটিং ‘বি’। বিদেশী ঋণ ও তারল্য পরিস্থিতি আরো প্রতিকূলে গেলে এ ঋণমান আরো কমে যাবে। এছাড়া আগামী বছর দেশের ডলার পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আরো চাপের মুখে পড়তে পারে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। 

বিশ্বব্যাপী মুডি’স, এসঅ্যান্ডপি ও ফিচ রেটিং—মার্কিন এ তিন প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত ঋণমানের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। বিশ্বের ক্রেডিট রেটিং বাজারের সিংহভাগই প্রতিষ্ঠান তিনটির নিয়ন্ত্রণে। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক শক্তি, বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও বৈদেশিক বাণিজ্যে এ তিন প্রতিষ্ঠানের দেয়া ঋণমানের প্রভাব পড়ে। 

এর আগে চলতি বছরের ৩১ মে বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ নামিয়ে দেয় মুডি’স। সে সময় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন বড় দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে চলমান সংকটের মধ্যেও বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। 

এবার বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দেয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় যুক্ত হলো এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুডি’স কর্তৃক ঋণমান অবনমনের ফলে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি তথা বৈদেশিক বাণিজ্যের শর্ত এরই মধ্যে বেশ কঠিন হয়ে গেছে। পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গিয়ে বাড়তি ফি ও শর্তের মুখে পড়তে হচ্ছে দেশের ব্যাংকগুলোকে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের সুদও বাড়তে শুরু করেছে। এ ধরনের ঋণের মেয়াদ কমে যাওয়ার পাশাপাশি নতুন নতুন শর্ত আরোপ হচ্ছে। বিশ্বের সুপরিচিত বৃহৎ ব্যাংকগুলোও বাংলাদেশী ব্যাংকের জন্য ক্রেডিট লাইন বা ঋণসীমা কমিয়ে দিচ্ছে বলে জানা গেছে। 

ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণমান নিয়ে মুডি’সের পর এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের নেতিবাচক মূল্যায়নের প্রভাবে বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্য আরো কঠিন হয়ে উঠবে। আরো সংকুচিত হয়ে পড়বে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসার পথ। সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের ব্যয়ও বেড়ে যাবে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘‌ক্ষতি যা হওয়ার অনেক আগেই হয়ে গেছে। এখন এর মাত্রা আরো বেশি তীব্র হচ্ছে। মুডি’স অনেক আগেই বাংলাদেশের ব্যাংক খাত সম্পর্কে নেতিবাচক রেটিং দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু দেশের রেটিং স্থিতিশীল থাকায় আমরা বিদেশীদের বলতাম, আমার ব্যাংক অন্যদের মতো নয়। তোমরা আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। কিন্তু গত মে মাসে মুডি’স দেশের রেটিংই খারাপ করে দিয়েছে। এবার এসঅ্যান্ডপিও বাংলাদেশের রেটিং নেতিবাচক বলেছে। তার মানে এখন দেশের কোনো ব্যাংকের হাতেই দরকষাকষির সুযোগ থাকল না। বিদেশীরা বলছে, তোমাদের দেশের রেটিংই তো খারাপ। দেশের রেটিং খারাপ হলে আর কিছু বলার থাকে না।’

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘কান্ট্রি রেটিং খারাপ হওয়ার কারণে এলসিতে বেশি ফি গুনতে হচ্ছে। অনেক বিদেশী ব্যাংক এলসি খুলতে নানা ধরনের শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। বিদেশী ব্যাংকগুলো আমাদের ক্রেডিট লাইন কমিয়ে দিয়েছে। মেয়াদ শেষ হওয়া বিদেশী ঋণ নতুন করে নবায়ন করা যাচ্ছে না। কেউ নবায়ন করলেও সেটির সুদহার বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আগামীতে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরো বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।’

বাংলাদেশের ঋণমান নিয়ে গতকাল নিজেদের ওয়েবসাইটে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। এতে বলা হয়, আগামী তিন বছর বাংলাদেশে ৬ থেকে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। বিবৃতিতে ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা নেয়ার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। 

বাংলাদেশের রেটিং নেতিবাচক করার যৌক্তিকতা তুলে ধরে এসঅ্যান্ডপি বলেছে, ‌বাংলাদেশ সরকারের বিদেশী মুদ্রায় স্বল্পমেয়াদে অর্থ পরিশোধের যে বাধ্যবাধকতা আছে, সেটির অবস্থা আগামী বছর আরো খারাপ হতে পারে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও এখন চাপের মুখে আছে। এরই মধ্যে ডলারের মজুদ এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। 

সরকারের চলতি হিসাবের আয় প্রত্যাশার চেয়ে কম হওয়া, সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি পূর্বাভাসকে ছাড়িয়ে যাওয়া ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে ব্যর্থতা বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং নেতিবাচক হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে উল্লেখ করেছে এসঅ্যান্ডপি। সংস্থাটি বলেছে, আগামী ১২ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত সূচকগুলো স্থিতিশীল করতে হলে অনুকূল বাণিজ্য পরিস্থিতি ও আর্থিক প্রবাহ (বিদেশী বিনিয়োগ) বাড়ানো প্রয়োজন।

এসঅ্যান্ডপি কর্তৃক দেশের ক্রেডিট রেটিং আউটলুক নেতিবাচক করার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মুডি’স সরাসরি বাংলাদেশের ঋণমান অবনমন করেছিল। এসঅ্যান্ডপি এখনো সেটি করেনি। প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের আউটলুক প্রকাশ করেছে। আশা করছি, এসঅ্যান্ডপি বাংলাদেশের ঋণমান অবনমনের পথে হাঁটবে না। কারণ বৈদেশিক বাণিজ্যের সব সূচকে বাংলাদেশ উন্নতি করেছে।’

হাবিবুর রহমান বলেন, ‘দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে তেমন কোনো সংকট নেই। কিছু বিষয়ে সমস্যা আছে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। গত অর্থবছরের শুরু থেকে যেসব সমস্যা বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল, সেগুলো এরই মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সবগুলো সূচক ইতিবাচক ধারায় ফিরবে।’

এদিকে এসঅ্যান্ডপি কর্তৃক ঋণমান নেতিবাচক করার দিনই দেশের ব্যাংক ও কার্ব মার্কেটে (খুচরা বাজার) ডলারের দাম বেড়েছে। মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ১০৯ টাকা। যদিও এ দরে ব্যাংকগুলোয় ডলার মেলেনি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। একাধিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানরা জানিয়েছেন, এসঅ্যান্ডপির মূল্যায়নে দেশের ঋণমান পরিস্থিতি ‘‌স্থিতিশীল’ থেকে ‘‌নেতিবাচক’ হওয়ার তথ্যটি প্রকাশের পর পরই ব্যাংকে প্রতি ডলারের বিনিময় হার দেড় থেকে ২ টাকা বেড়ে যায়। ব্যাংকগুলো গতকাল গ্রাহকদের কাছ থেকে ডলারপ্রতি ১১৪-১১৫ টাকাও আদায় করেছে। আর কার্ব মার্কেটে  ডলার ১১৪ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও একদিন আগে কার্ব মার্কেটে ডলারের দর ছিল ১১২-১১৩ টাকা।

মুডি’স ও এসঅ্যান্ডপির মতো প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতিবাচক রেটিং বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে বলে মনে করেন এবিবির আরেকজন সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান। বর্তমানে ট্রাস্ট ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এ অভিজ্ঞ ব্যাংকার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিং খারাপ হয়ে গেলে তখন ব্যাংকগুলোর আর কিছু করার থাকে না। বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রতিটি ধাপেই আগের চেয়ে বেশি চার্জ, ফি ও সুদ পরিশোধ করতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিদেশী ঋণ পেতে বিপদে পড়বেন। দেশের ক্রেডিট রেটিং উন্নতির জন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।’ 

প্রসঙ্গত, ২০২১-২২ অর্থবছরজুড়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি পার করে বাংলাদেশ। ওই বছর রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানির ধাক্কায় বাণিজ্য ঘাটতিতে ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতির পাশাপাশি সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতিও ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। এ অবস্থায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের আমদানি ঋণপত্রের (এলসি) লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার সংকটের পাশাপাশি এলসি খোলার শর্ত কঠোর করায় আমদানির পরিমাণ ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ কমে এসেছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে ৬৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়। আর পণ্য রফতানি হয় ৪৭ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের। অর্থবছরের ১১ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে ৮ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। ব্যাংকগুলোর এলসি দায় ও বিদেশী ঋণ পরিশোধে শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। চলতি জুলাইয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। গত ১৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও আইএমএফের নির্দেশনা অনুযায়ী (বিপিএম৬) রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। 

চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের সরকারি-বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৫ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৭৩ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার সরকারি ঋণ। বাকি ২২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ এসেছে বেসরকারি খাতে। গত এক বছরে সরকারের বিদেশী ঋণ স্থিতি বাড়লেও বেসরকারি খাতে কমেছে। ২০২২ সালের জুনে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ ছিল ২৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ নতুন করে নবায়ন করতে চাইছে না। আবার ব্যবসায়ীরাও সুদহার ও ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় বিদেশী ঋণ পরিশোধ করে দিচ্ছেন। এ কারণে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হয়ে এসেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন