বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন

শাটল যেন ‘‌চলন্ত ক্যাম্পাস’

ইমাম ইমু

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেলওয়ে স্টেশন ছবি: গিয়াস উদ্দিন

শাটল ট্রেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের আবেগ ও ভালোবাসার অন্য নাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন কিন্তু শাটলে চড়েননি—এমন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আবার শাটলে চড়ে তার প্রেমে পড়েননি—এমন কেউও নেই।৷ শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের জ্ঞানগৃহে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম এ শাটল ট্রেন। প্রতিদিন ১০-১২ হাজার শিক্ষার্থী শাটলে চড়ে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া করেন। সপ্তাহে পাঁচদিন দুটি শাটল সাতবার আসা-যাওয়া করে। 

ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার পথে পুরোটা সময়জুড়ে আড্ডা-গানে মুখর থাকে শাটলের সব বগি। বগি চাপড়িয়ে গানে গানে শাটল মাতিয়ে রাখেন শিক্ষার্থীরা। রক-র‌্যাপের পাশাপাশি জারি-সারি, ভাটিয়ালি, প্যারোডি, পাহাড়ি ও বাংলা সিনেমার গানসহ এমন কোনো গান হয়তো বাদ নেই, যা শাটলে গাওয়া হয় না। এ শাটলে বগি চাপড়িয়ে গান গেয়ে এরই মধ্যে দেশবরেণ্য তারকার খেতাবও কুড়িয়েছেন অনেকেই। এর মধ্যে রয়েছেন কণ্ঠশিল্পী নকিব খান, পার্থ বড়ুয়া ও এসআই টুটুলের মতো দেশবরেণ্য শিল্পীর নাম। বিভিন্ন রকম কবিতা, গান, আড্ডা আর হাসি-ঠাট্টায় মুখরিত থাকে শাটল ট্রেন। শিক্ষার্থীদের আবেগের মিশেলে এটি যেন গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গী হিসেবে পরিণত হয়েছে। আবার প্রাণের শাটলকে নিয়ে কবিতা কিংবা গান লিখেছেন অনেকেই। তৈরি হয়েছে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। চবির নাম নিলে শাটল ট্রেনের নাম যেন চলে আসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। চবির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ শাটল ট্রেন।

শহর থেকে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ১৯৮১ সালে চবিতে প্রথম শাটল ট্রেন চালু হয়। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম সুবিধা নেই। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও বর্তমানে শাটলের ব্যবস্থা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা থাকলেও কয়েক বছর আগে তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সবুজঘেরা চবি ক্যাম্পাসই এখন বিশ্বে একমাত্র শাটলের ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রায় ৪২ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের বয়ে আনা এ শাটল যেন কালের সাক্ষী ও বহু ঐতিহ্যের ধারক-বাহক।

শাটল ট্রেনের প্রতিটি বগি, শিট ও পাটাতন শিক্ষার্থীদের গল্প-আড্ডা, খুনসুটি আর বন্ধুত্বের বেড়াজালে গানের প্রাণরসে পরিপূর্ণ আসর জমানোর প্রধান বাদ্যযন্ত্র। ক্লাস শেষে ক্লান্ত দেহে ঝাপসা আবহ পেছনে ফেলে শিক্ষার্থীরা আপন মনে গলা মেলায় সুরের মূর্ছনায়। অগ্রজ-অনুজ সম্পর্কের দূরত্ব ভুলে সৃষ্টি হয় প্রাণবন্ত মুহূর্ত, উচ্ছ্বসিত আনন্দঘন পরিবেশ। ভিন্ন দৃশ্যের দেখাও মেলে শাটলে। কেউ কেউ হেডফোন কানে গুঁজে গান শোনা কিংবা আলাপচারিতায় কাটে ক্লান্তির বিকাল। কেউবা প্রেয়সীর কাঁধে মাথা রেখে পথ চলে যায় হেলেদুলে। কেউ আবার জানালার পাশে তাকিয়ে সবুজে হারায় আনমনে। দুই পাশে সবুজ ফসল আর ঝোপঝাড়ের বুক চিরে সর্পিল পথ ধরে শাটল চলে আপন গতিতে।৷ আড্ডা-গান ছাড়াও দলবেঁধে পাঠ্যালাপ কিংবা জ্ঞানচর্চার মাধ্যমও শাটল ট্রেন। সব মিলিয়ে এ যেন শিক্ষার্থীদের জন্য ‘‌চলন্ত ক্যাম্পাস’। এই শাটল ট্রেনকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাসি-কান্না বা প্রেম-ভালোবাসা ও আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য। এ মহাকাব্যের কিছু সময়, কিছু ঘটনা আর অনুভূতি নিয়ে নির্মিত হয়েছে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘শাটল ট্রেন’।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪তম ব্যাচের চারুকলা বিভাগের সাবেক ছাত্র ও চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রদীপ ঘোষের পরিচালনা এবং ৩৪তম ব্যাচের ফাইন্যান্স বিভাগের রিফাত মোস্তফার সহকারী পরিচালনায় এতে অভিনয় করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬তম ব্যাচের ছাত্রী মোহসেনা ঝর্ণার ‘বহে সমান্তরাল’ গল্প অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রেম-ভালোবাসা, বিচ্ছেদ ও শিক্ষাঙ্গনের নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে।

সম্প্রতি জার্মানির বার্লিন থেকে আসা গ্রাফিতি শিল্পী লুকাসের রঙতুলির ছোঁয়ায় অন্যরকম রূপ ধারণ করেছে চবির শাটল ট্রেন। তুলির আঁচড়ে শাটলের বগিগুলো মূর্ত হয়ে উঠেছে বাংলার চিরায়ত সৌন্দর্য। বিবর্ণ শাটলের ভিন্ন এ রূপ নজর কাড়ছে সবার। ব্যতিক্রমী শিল্পকর্মে মুগ্ধ শিক্ষার্থীরাও।

শাটলের সৌন্দর্য বর্ণনা দিয়ে চবি শিক্ষার্থী রেদওয়ান আহমদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সংস্কৃতির এক অনন্য অনুষঙ্গ শাটল ট্রেন। শুধু ট্রেন বললে ভুল হবে। একে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণও বলা যায়। ঐতিহ্যের ধারক এ শাটল ট্রেন ঘিরে প্রতিটি শিক্ষার্থীর কত যে সুখ-দুঃখের গল্প জড়িয়ে আছে, তার হিসাব নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন