ব্যর্থ আমার হাতেই হোক নতুন প্রজন্মের জন্ম

ওবায়দুল্লাহ সনি

প্রকৃতি এবং এর গাছপালা, জীবজন্তু, পাখপাখালি, আশপাশসবকিছু মিলেই আমাদের সত্যিকারের পরিবার। ইংরেজ কবি অ্যাডওয়ার্ড জেমস টেড হিউজের লেখা ‘মাই ওন ট্রু ফ্যামিলি কবিতাটি অন্তত তাই মনে করিয়ে দেয়। কবি একদা স্বপ্নে দেখেন, কাঠের খুঁটিতে তাকে বেঁধে রেখেছে একদল ওক গাছ। রাগান্বিত দৃষ্টিতে সব গাছই তাকিয়ে। তাদের মধ্য থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ গাছ জানায়, তারা তার বন্ধু এবং সত্যিকারের পরিবার। কিন্তু তাদের যখন কেটে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল, তখন কবি এর বিরোধিতা করেননি। তাই এবার অরণ্যের অধিকার পেতে নতুন করে তাকে প্রতিশ্রুতি দিতে বলে যে কেউ একটি গাছ কেটে ফেললে তিনি দুটি গাছ লাগাবেন। আর শপথ না করলে তারা তাকে হত্যা করবে এবং ওক গাছের মধ্যে যেখানে জন্মেছিলেন সেখানেই তাকে কবর দেয়া হবে। কবি সেখানে জন্ম নিলেও বনের একেবারে ধারে বড় হননি। তাই গাছ বাঁচানোর মনোভাব তার জানা ছিল না। স্বপ্ন ভাঙতেই কবির চৈতন্য হয়। উপলব্ধি করেন, প্রকৃতিই তার আসল পরিবার।

গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান; ‘একটি গাছ একটি প্রাণ; ‘পরিবেশ সকলের, তাকে রক্ষা করার দায়িত্বও সকলের’—এমন সব নানা স্লোগান সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। এখন কথা হচ্ছে, শুনছি তো বহু দিন ধরে, কিন্তু সেগুলো মানছি কি?

সব খারাপের প্রভাব যে পরিবেশের ওপর পড়বে। সর্বোপরি, মানুষই এর খারাপ ফল ভোগ করবে, সেই বোধ এখনো অনেকের মধ্যে জন্মায়নি। তবে নতুন কোনো প্রলয় যখন মানুষের অস্তিত্বকেই পুনরায় প্রশ্নের মুখে এনে ফেলে, তখন প্রত্যাশিতভাবেই সভ্যতার সব সাজানো সৌধকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়। হঠাৎ স্তিমিত হয়ে আসে প্রযুক্তি, প্রগতির প্রয়োজন। বহু তত্ত্ব, প্রজ্ঞা পেরিয়ে এসে সহজেই তখন মিলে যায় জীবনের হিসাবপ্রাচুর্যই জীবনের লক্ষ্য কিংবা মোক্ষ নয়। সুখের ঠিকানা তো নয়ই। বরং উল্টোটাই সত্যি। সেই ভাবনার খাতা খুলে দিয়ে কভিডকালে নিজেকে রাঙায় প্রকৃতি। আর আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়এতদিন আমরা তাকে ঢেকে রেখেছিলাম দূষণের চাদরে। সে দেখিয়ে দিয়েছে, মানুষকে ছাড়া প্রকৃতি কীভাবে নিজেকে সারিয়ে তোলে। কীভাবে কার্বন নিঃসরণ তলানিতে ঠেকে, মহাকালের ঘড়ি উল্টো দিকে চলতে শুরু করে! সেই গাঢ় সবুজ দেখে চমকে উঠলাম। পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী নয়, সে কথা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। অন্য প্রাণীদের তোয়াক্কা না করে পরিবেশের বারোটা বাজিয়েছি স্বার্থপরের মতো। প্রকৃতি থেকে কতখানি দূরত্ব বেড়েছে আমাদের। যেন নিজেরই বসত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি। আসলে প্রকৃতির সবাই ভালো না থাকলে একা কেউ ভালো থাকতে পারে না। সবাইকে নিয়েই তো জীবন।

 শিল্প বিপ্লব-এর মাধ্যমে যে নগরসভ্যতার সূচনা হয়েছিল, সেই থেকে যন্ত্রসভ্যতা, শিল্পোৎপাদনে কলকারখানার আবির্ভাব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ এবং যুদ্ধোত্তর আণবিক পারমাণবিক শক্তি প্রতিযোগিতাসব মিলিয়ে পরিবেশকে দূষিত করে তার স্বাভাবিকতা নষ্ট করেছি। জড় জগতের বৈভব, প্রাচুর্য, বিলাসবহুল জীবনযাত্রার মোহে আমরা মেনে নিয়েছি ইট-পাথরের নাগরিক জীবনকে। অর্থপিপাসু হয়ে নগরসভ্যতার পত্তনের জন্য নির্বিচারে, নিষ্ঠুরভাবে গাছপালা কেটেছি। ধ্বংস করেছি অরণ্য। সৃষ্টি করেছি বিশ্ব উষ্ণায়ন। ক্রমবর্ধমান মানবসভ্যতায় উন্নয়নের নামে প্রকৃতিকে অবহেলা করে আজ আমরা এক ভয়াবহ বিপদে বিপর্যস্ত। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর বন্যপ্রাণী জগৎ প্রতি দশকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার হারে অপেক্ষাকৃত শীতল স্থানে সরে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে পৌনে দুই লাখ লোক মারা যাচ্ছে। আর সারা বিশ্বে মৃত্যু হচ্ছে ৮৩ লাখ মানুষের। এমনকি যত লোকের অকালমৃত্যু হয়, তার প্রায় ১৫ শতাংশেরই মৃত্যু হচ্ছে নানা ধরনের দূষণে।

 দাঁত থাকতে যেমন দাঁতের মর্ম কেউ বোঝেন না, তেমনই গাছের মর্মটাও কেউ বুঝতে চান না। শহরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে এসির ব্যবহার, বাড়িঘর বেড়েছে, বেড়েছে গাড়ির সংখ্যা। পাল্লা দিয়ে কমেছে কেবল গাছ। ঢাকা থেকে তাই ধীরে ধীরে সবুজ উধাও হতে বসেছে। কখনো রাস্তা সম্প্রসারণের নামে, কখনো উন্নয়নের নামে, কখনো আবার বাড়ি তৈরির অজুহাতেসব ক্ষেত্রেই বলি হচ্ছে উদ্ভিদ। অথচ সবাই জানেন, গাছ ছাড়া কিছু বেঁচে থাকবে না। পরিবেশে অক্সিজেনের ভারসাম্য বজায় রাখতে একমাত্র তাকেই ভরসা। তবুও আমাদের উন্নয়নের শহরে শুধু গাছটাই যেন বাড়তি, ফেলনা। নগর কর্তৃপক্ষের এমন দৃষ্টিভঙ্গির খেসারতই এখন সবাইকে দিতে হচ্ছে। অবিলম্বে যদি এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা না যায় এবং অপরিমিত গাছ না লাগানো হয়, তবে মহাবিপদের অপেক্ষায় দিন গোনা ছাড়া কোনো গতি নেই।

 ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে গাছ কাটা নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, ‘গাছ কাটা নিয়ে কেউ কেউ মর্মাহত হতেই পারেন, কষ্ট পেতেই পারেন। এটা তাদের আবেগের বিষয়। তবে উন্নয়নকাজে অনেক সময় গাছ ফেলে দিতে হয়, কেটে ফেলতে হয়। কিন্তু আমরা তখনই করি, যখন নিতান্তই আর কোনো উপায় থাকে না। মেয়রকে বিনীতভাবে বলতে চাই, অবশ্যই আমরা উন্নয়ন চাই। তবে বৃক্ষ ধ্বংস করে নয়, আমার শহর এগিয়ে চলুক সবুজকে আঁকড়ে ধরেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গাছ রক্ষা করেই নগর উন্নয়ন করা হয়। এখন কথা হচ্ছে, তারা যদি পারে, আপনারা পারছেন না কেন?

 কলেজে পড়ার সময় আমি রোভার স্কাউটে জড়িত ছিলাম। আয়োজন করে প্রতি বছরই ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে গাছ লাগানো হতো। কয়েক দিন তার যত্নও নেয়া হয়। সপ্তাহখানেক বাদে তার দিকে তাকাতেও ভুলে যায় সবাই। একে তো গাছ কাটা হচ্ছে নির্বিচারে, তার পর যদি এটুকু সচেতন না হই সবারই তবে সমূহ বিপদ। আগে পার্কে বেড়াতে যেতাম, মাঠে খেলতাম। এখন আর মাঠ নেই, পার্কে তেমন গাছ নেই। শিশুরা তাই বাড়িতে বসে মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে গেমস খেলে। এটা সার্বিকভাবে সামাজিক একটা দূষণ। এ থেকে বাঁচতে হলেও আমাদের আরো বেশি করে গাছ লাগানো প্রয়োজন।

 বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে মার্কিন রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল। সমসাময়িক ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো ঘটনা নাড়া দিয়েছিল দেশটির জনগণকে। তাই বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছিল যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন। সঙ্গে অন্য সামাজিক বিষয়েও সচেতনতা তৈরি হচ্ছিল মানুষের মধ্যে। তবে পরিবেশ নিয়ে তখনো খুব একটা আলোচনা ছিল না। তবে ১৯৬২ সালে পুরো প্রেক্ষাপট বদলে দেন সমুদ্র জীববিজ্ঞানী র‍্যাচেল লুইজ কার্সন। তার লেখা ‘সাইলেন্ট স্প্রিং বইয়ে তিনি পরিবেশের ওপর কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তারিত তুলে ধরেন। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে তুমুল গণআলোড়ন সৃষ্টি করে বইটি। জন্ম নেয় আধুনিক পরিবেশ আন্দোলনের। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে পরিবেশ বাঁচানোর প্রয়োজনীয়তা। এরপর বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশক, যেমন ডিডিটি ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রে। বর্তমান শতাব্দীতে পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে সুইডিশ স্কুলছাত্রী গ্রেটা থুনবার্গের ‘ফ্রাইডে, ফর ফিউচার আন্দোলন সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

 এক-একটি বিশেষ ভাবনা নিয়ে প্রতি বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন হয়। তাতে বিভিন্ন রূপে থাকে সবুজায়নের চেষ্টা। দিনটি হতে পারে নতুন প্রজন্মের জন্যও শিক্ষা। বাড়ির শিশুকে দেয়া যায় একটা সবুজ ভাবনায় ভরা দিন। একসঙ্গে আনন্দ করেই পরিবেশ সম্পর্কে কিছুটা সচেতনতার ছোঁয়া দেয়া যায় শিশুর মনে। এমন একটা দিন যে পালন করা হয়, সে বিষয়ে তথ্য দিয়ে কথা বলার শুরুটা হতে পারে। তবেই অবুঝ মনে প্রশ্ন উঠবেকেন পরিবেশের কথা আলাদা করে ভাবা প্রয়োজন? তার পিঠে কথার মাধ্যমেই বুঝিয়ে বলা যায় এ দিক-সেদিক প্লাস্টিক না ফেলা, পানি নষ্ট না করা, পশু-পাখিকে আঘাত না করার মতো কাজের কথা।

এমন কিছু কাজের আয়োজন করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে শিশুটি হয়ে উঠবে নিজের চারপাশ সম্পর্কে সচেতন। এ দিনটায় পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে আনন্দ করা প্রয়োজন। লাগানো হোক কয়েকটি গাছ। এর জন্য বাগান থাকার প্রয়োজন নেই। বাড়ির বারান্দায় নিজের হাতে গাছ লাগানো শিখুক শিশুটি। তবেই তার ভেতর গাছের যত্ন করতে বেশি আগ্রহ জন্মাবে। অন্য গাছের প্রতিও ভালোবাসা তৈরি হবে। সে ধীরে ধীরে বুঝতে শিখে যাবে, চারপাশ সুস্থ ও সুন্দর থাকলে তবেই ভালো থাকা সম্ভব। কবি টেড হিউজের কবিতাটির সুরে আমাদেরও পরিবর্তন ঘটুক।

ওবায়দুল্লাহ সনি: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন