স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে কৃষিপণ্য রফতানির হারে পিছিয়ে বাংলাদেশ

শাহাদাত বিপ্লব

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে কৃষিপণ্য রফতানির হারে সবচেয়ে পিছিয়ে আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়া, অ্যাঙ্গোলা, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ও দক্ষিণ আমেরিকার গায়ানা। এর পরই বাংলাদেশের অবস্থান। অর্থাৎ রফতানি আয়ে কৃষিপণ্যের যে অবদান, সে তালিকার সর্বশেষ পাঁচটি দেশের একটি বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) দেশ থেকে রফতানি হয়েছে ৫২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পণ্য। এর মধ্যে কৃষি ও মৎস্য পণ্য ছিল ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের মতো। অর্থাৎ মোট রফতানিতে কৃষিপণ্যের অবদান মাত্র ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) এবং বাংলাদেশ ট্রেড ফেসিলিটেশন (বিটিএফ) থেকে প্রকাশিত ‘ইম্পলিকেশন অব এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন ফর এগ্রিকালচারাল এক্সপোর্টস ফ্রম বাংলাদেশ: ইস্যুজ অ্যান্ড পলিসি অপশনস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। 

বিভিন্ন দেশে রফতানির ক্ষেত্রে এলডিসি সুবিধা পেয়ে থাকে বাংলাদেশ। অনেক দেশেই দিতে হয় না কোনো ধরনের শুল্ক। তবে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্ত হবে ট্যারিফ হার। এতে সার্বিক রফতানির পাশাপাশি কৃষিপণ্য রফতানিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাই এখন থেকেই কৃষিপণ্যের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গুণগতমান ঠিক রাখতে উদ্যোগ নেয়া জরুরি। অন্যথায় এলডিসি উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে বলে জানান তারা। 

এ বিষয়ে কথা হয় পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (আরএপিআইডি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে, যিনি গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এলডিসি উত্তরণের পর কৃষি রফতানিতে কী প্রভাব ফেলতে পারে, আমরা শুধু সে বিষয়টির ওপর গবেষণাটি পরিচালনা করেছি। যদিও আমাদের কৃষি রফতানি কম। এলডিসি উত্তরণের পর রফতানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে যাবে। এজন্য এখন থেকেই আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং গুণগতমান বাড়াতে হবে। আমাদের অনেক পণ্য আছে কিন্তু ভালো মান না থাকায় বিদেশের বাজারে রফতানি করতে পারছি না। এজন্য এখন থেকেই প্রস্তুত হতে হবে।’ 

আবদুর রাজ্জাক আরো বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে কৃষি রফতানিতে আমাদের অবস্থান অনেক নিচে। এর একটি কারণ রয়েছে। আমাদের মোট রফতানির বড় একটি অংশ তৈরি পোশাক থেকে আসে। অন্য দেশগুলোর সেভাবে আসে না। তাদের রফতানি অনেকটা কৃষিনির্ভর। এ কারণে মোট রফতানিতে কৃষির হার আমাদের কম।’

ইউএসডিএর গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রায় ১৬০টিরও বেশি দেশে কৃষিপণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ। যদিও এর অর্ধেকেরও বেশি রফতানি হয় শুধু ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সৌদি আরবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কৃষিপণ্য পাঠানো হয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত তিন বছরে দেশটিতে মোট কৃষিপণ্যের ২২ শতাংশ রফতানি হয়েছে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে এ সময় ১৯ দশমিক ৪, সৌদি আরবে ৮ দশমিক ৭, যুক্তরাজ্যে ৭ দশমিক ৫ এবং মালয়েশিয়ায় ৫ দশমিক ৭ শতাংশ রফতানি হয়। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫, যুক্তরাষ্ট্রে ৪ দশমিক ৫, নেপালে ২ দশমিক ৮, চীনে ২ দশমিক ৭, কাতারে ২ দশমিক ২ এবং অন্যান্য দেশে ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ রফতানি হয়।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশে রফতানির ক্ষেত্রে ট্যারিফ সুবিধা পেয়ে থাকে। কিন্তু এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এসব দেশে রফতানিতে নতুনভাবে ট্যারিফ হার যুক্ত হবে। এক্ষেত্রে ভারতে ট্যারিফ হার যুক্ত হবে আরো ১১ শতাংশ, জাপানে ২০ দশমিক ২ শতাংশ, কানাডায় ২ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৩ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ৬ বা ১০ শতাংশ এবং চীনে ১০ শতাংশ। এতে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কৃষিপণ্য যায় এমন সাতটি দেশে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত রফতানি কমে যেতে পারে। 

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত তিন বছরে সাতটি দেশে গড় রফতানি হয়েছে ৪৮২ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্য। তবে এলডিসি উত্তরণের পর ট্যারিফ হার বেড়ে যাওয়ার কারণে ২৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার থেকে ৫৩ দশমিক ৭১ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত কৃষিপণ্যের রফতানি কমে যেতে পারে। এর মধ্যে ভারতে ২১ থেকে ৪৩ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত রফতানি কমে যেতে পারে, যা এ খাতের মোট রফতানি আয়ের ১১ থেকে ২১ দশকি ৯ শতাংশ। 

রাজধানীর পর্যটন ভবন মিলনায়তনে গতকাল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ আয়োজিত ‘কৃষি খাতে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের প্রভাব ও করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালায় গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। সেখানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, ‘এলডিসি উত্তরণের পর রফতানির পরিমাণ হয়তো কমে যেতে পারে, যেহেতু দাম বেড়ে যাবে। আবার অনেক সুবিধাও কিন্তু যুক্ত হবে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন আমাদের অনেক এগিয়ে দেবে। কৃষিতে ভর্তুকি জিডিপির ১০ শতাংশ পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এখন মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ আছে।’ 

কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপিয়ান দেশ বা অন্যান্য দেশে রফতানির ক্ষেত্রে আমরা বেশকিছু সুবিধা পেয়ে থাকি। কিন্তু এলডিসি উত্তরণে রফতানিতে ততটা প্রভাব ফেলবে না বলে আশা করি। আমাদের চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগোতে হবে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। বিভিন্ন দেশ নিরাপদ খাবার নিতে চায়। তাই খাদ্যপণ্য বিভিন্ন দেশে রফতানির সুযোগ রয়েছে।’ মন্ত্রী আরো বলেন, ‘রফতানির সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। কৃষি রফতানিতে আমরা প্রণোদনা দিই। এটা অব্যাহত থাকবে। কৃষিকে রফতানিমুখী করার জন্য যা যা সুবিধা দেয়া দরকার সবই দেয়া হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। রফতানির ক্ষেত্রে কৃষির যে সম্ভাবনা তা কাজে লাগাতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন