সময়ের ভাবনা

অর্থনীতির ওপর উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব

নিজাম আশ শামস

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের নেতিবাচক প্রভাব ও তা রোধে অনেক দিন ধরেই আলোচনা চলছে। সারা বিশ্বে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নেয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেমিনারের আয়োজন করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মতামত দিচ্ছেন। আশু কর্তব্য সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হুমকি ও ফলাফল সম্পর্কে বারবার সতর্ক করছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। উষ্ণায়ন যেন পাগলা ঘোড়া! কোনোভাবেই এর রাশ টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। আর এর ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হচ্ছে সারা বিশ্বের মানুষ। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। সাম্প্রতিক দিনগুলোয় গরমের তীব্রতা সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। উত্তরোত্তর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অতিষ্ঠ জনজীবন। আক্ষরিক অর্থেই ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে’ যেন ধ্বনিত হচ্ছে প্রতিটি মানুষের অন্তরে। 

গরমের তীব্রতা বৃদ্ধিতে মানুষের শরীরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। নানা রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। অনেক মানুষ হিট স্ট্রোকে মারা যায়। পাশাপাশি তাপমাত্রা বৃদ্ধি একটি দেশের অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। অবকাঠামো ধসে পড়ে। কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। বিদ্যুতের ওপর চাপ পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেরেক লেমইন সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি গবেষণা করেছেন। তা থেকে জানা যায়, যদি বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলে কৃষিজ উৎপাদন ৬০ শতাংশ কমবে। 

উচ্চ তাপমাত্রার কারণে খরার সম্ভাবনা বাড়ে। তখন সমস্যা দ্বিগুণ হয়। অর্থনীতির ওপর উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব নিয়ে গবেষক ইরিনা ইভানোভা একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। এর শিরোনাম দ্য ডিভাসটেটিং ইকোনমিক টোল অব সিভিয়ার হিট ওয়েভস (২০ জুলাই, ২০২২ প্রকাশিত)। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ইউরোপের প্রায় অর্ধেক অংশ বর্তমানে খরার ঝুঁকিতে আছে। ফলে খাদ্য ঘাটতি হতে পারে বলে ইউরোপীয় কমিশন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণার বরাত দিয়ে ইরিনা ইভানোভা জানান যে অত্যধিক তাপমাত্রা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে প্রতি ১ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে একটি দেশের জিডিপি দশমিক ২৫ শতাংশ কমে যায়। এ প্রসঙ্গে ইরিনা ইভানোভা ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর হেলথ অ্যান্ড দ্য গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টের অধ্যাপক ক্রিস্টি এবির সঙ্গে কথা বলেন। এবি তাকে জানান, ‘যখন তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়, লোকেরা তেমন কাজ করতে চায় না।’

অর্থনীতির ওপর উচ্চ তাপমাত্রার নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে নিউইয়র্কভিত্তিক টাইম ম্যাগাজিনে একটি প্রবন্ধ লেখেন কিয়ারা নুজেন্ট। এর শিরোনাম রাইজিং হিট ইজ মেকিং ইট হার্ডার টু ওয়ার্ক ইন দি ইউএস অ্যান্ড দ্য কস্টস টু দি ইকোনমি উইল সোয়ার উইথ ক্লাইমেট চেঞ্জ (৩১ আগস্ট, ২০২১ প্রকাশিত)। কিয়ারার লেখা থেকে জানা যায়, অত্যধিক তাপমাত্রা বাড়ার কারণে কর্মীদের কাজ করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি শত শত বিলিয়ন ডলার হারাচ্ছে। জলবায়ু নিয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক অ্যাড্রিন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। প্রতিবেদন অনুসারে, অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর আনুমানিক ১০ হাজার কোটি ডলার হারাচ্ছে। তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে ২০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এটি সে দেশের জিডিপির প্রায় দশমিক ৫ শতাংশ। ২০৫০ সালের মধ্যে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ হবে ৫০ হাজার কোটি ডলার, যা দেশটির জিডিপির ১ শতাংশ। 

বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছর বিপুল আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে প্রিভেনশন ওয়েব-এ ঢাকা’স পুওর আর সাফারিং ফ্রম হিটওয়েভ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ হয় (২২ অক্টোবর, ২০২২ প্রকাশিত)। সেখানে অ্যাড্রিন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের সূত্রে জানানো হয়, অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে ঢাকা শহরের কর্মীদের কাজ করার ক্ষমতা কমে যায়। ফলে প্রতি বছর শহরটি ৬০০ কোটি ডলার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ ক্ষতির পরিমাণ ঢাকা শহরের মোট উৎপাদন ক্ষমতার ৮ শতাংশেরও বেশি। যদি তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে এ পরিমাণ বেড়ে ১০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। প্রিভেনশন ওয়েবে প্রকাশিত প্রবন্ধটি থেকে আরো জানা যায়, অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছর ৭০০ কোটি কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। মাথাপিছু হিসেবে কর্মঘণ্টা কমার এ পরিমাণ ২৫৪ ঘণ্টা। দ্য ক্লাইমেট রিয়েলিটি প্রজেক্টে প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধের শিরোনাম হাউ দ্য ক্লাইমেট ক্রাইসিস ইজ ইমপ্যাক্টিং বাংলাদেশ (৯ ডিসেম্বর, ২০২১ প্রকাশিত)। সেখানে জার্মানওয়াচ-এর ২০২১ সালের গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সের সূত্রে জানানো হয়, জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। জার্মানওয়াচের প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৭২ কোটি ডলার। এ বিষয়ে প্রিভেনশন ওয়েবে প্রকাশিত আরেকটি প্রবন্ধের শিরোনাম অ্যাডাপ্টিং টু দ্য ইমপ্যাক্টস অব এক্সট্রিম হিট ইন বাংলাদেশ’স লেবার ফোর্স (৩ মে ২০২৩ প্রকাশিত)। প্রবন্ধটিতে উল্লেখ করা হয়, তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে কর্মীদের কাজ করার ক্ষমতা ১৬ শতাংশ কমে যায়। ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে কর্মক্ষমতা কমে ২৯ শতাংশ আর তাপমাত্রা যদি ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, সেক্ষেত্রে কর্মক্ষমতা ৪৭ শতাংশ কমে যায়। 

উল্লিখিত আলোচনা থেকে এ কথা পরিষ্কার যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে একটি দেশের অর্থনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। তাই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আপামর জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। তাদের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘সবুজ অর্থনীতি’র ধারণা বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। কারখানাগুলোকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে তৈরি করতে হবে। ‘সবুজ কর’ নিশ্চিত করতে হবে। ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক উভয় ক্ষেত্রেই পরিবেশ দূষণকারী কর্মকাণ্ডের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে হবে। তা না হলে তাপমাত্রা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে। ফলে আমাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি তো হবেই, অর্থনৈতিক ক্ষতিও ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। 

নিজাম আশ শামস: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন