বাংলাদেশ সরকারকে সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভরতা কমানোর পরামর্শ

শ্রমিকের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ব্যবস্থা নিন

ছোট্ট ভূখণ্ডে অত্যধিক জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সুশাসনের অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, ঘুস-দুর্নীতি, অদক্ষ বন্দর, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি সমস্যা সত্ত্বেও ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। দেশী-বিদেশী অর্থনীতিবিদদের অনেকেই এটাকে ‘বাংলাদেশ মিরাকল’ বলে বিস্ময় প্রকাশ করেন। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, এর পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে সস্তা শ্রম। নিম্ন আয়ের দেশ থাকা অবস্থায় সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর করে উন্নয়ন স্বাভাবিক বিষয় হলেও বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। লক্ষ্য উচ্চমধ্যম আয়ে উন্নীত হওয়া। এক্ষেত্রে শ্রমমজুরি যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি বাড়াতে হবে শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও শ্রমিকের দক্ষতা। যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ, কারিগরি শিক্ষা জোরদার এবং আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে সস্তা শ্রম থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসতে পারে। এতে অধিক মূল্যসংযোজনের মাধ্যমে অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে সক্ষম হবে সবাই। 

শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও উৎপাদনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। শ্রমিকরা মজুরি বাড়ানোর কিংবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবি তুললে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিকভাবেই তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর কথা বলেন। উৎপাদনশীলতা বাড়লেই শ্রমিকদের মজুরি ও অন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো সম্ভব হয়। এ কারণে প্রতিষ্ঠানও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যায় এবং লাভজনক পর্যায়ে পৌঁছে। বর্তমানে যে পরিমাণ দক্ষ শ্রমিক দরকার তা মিলছে না। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, তৈরি পোশাক শিল্প ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে উচ্চপর্যায়ে দক্ষ লোকের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। বিআইডিএসের গবেষণায় উঠে এসেছে, কোথাও অষ্টম শ্রেণী পাস কর্মীর দরকার হলে দরখাস্ত আসছে মাস্টার্স পাসের। আবার কোথাও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী দরকার হলে সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের শ্রমিকদের মধ্যে কর্মক্ষমতা কম। এক্ষেত্রে সবার ওপরের অবস্থানে সিঙ্গাপুর আর বাংলাদেশের অবস্থান নিচ থেকে চতুর্থ। অর্থাৎ কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের পরে। এছাড়া ভারত, শ্রীলংকা, মঙ্গোলিয়াসহ অনেক দেশই বাংলাদেশের পরে অবস্থান করছে। গত বছর প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমিক, যা উদ্বেগজনক। অর্থাৎ ব্যক্তি উদ্যোক্তারাও শ্রমিকের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের বিষয়ে আগ্রহী নয়।

নিম্ন শ্রমদক্ষতা ও সস্তা শ্রমনির্ভর উন্নয়নকে অনেকে মধ্যম আয়ের ফাঁদ হিসেবে অভিহিত করেন। মধ্যম আয়ের ফাঁদ হলো এমন একটি স্থবির অবস্থা, যেখানে নিম্ন আয়ের দেশ মধ্যম আয়ের প্রথম ধাপ অতিক্রম করার পর দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছে আটকে যায়। অর্থাৎ নিম্নমধ্যম আয়ের ধাপ পার হয়ে আর সামনে এগোতে পারে না। ফলে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের পথে না গিয়ে একটি অবস্থায় স্থবির হয়ে যায়। ফাঁদ তৈরির বিষয়টি এমন, একটি দেশ সস্তা শ্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার ম্যানুফ্যাকচারিং সামগ্রী তৈরি করে আয়ের উচ্চস্তরে পৌঁছে যায়, যেখানে মজুরি বাড়ানোর বিষয়টি আবশ্যিক হয়ে ওঠে। অর্থনীতির এ পর্যায়ে মজুরি বৃদ্ধির হার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। ফলে সস্তা শ্রম দ্বারা আগে উৎপাদিত পণ্য আর তৈরি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি ও সার্বিকভাবে মোট জাতীয় উৎপাদন কমে যেতে পারে। এমনকি সস্তা শ্রম যেখানে পাওয়া যায়, ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর সে দেশ থেকে অন্য দেশেও স্থানান্তর হয়ে যেতে পারে। উপরন্তু উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ থেকে ওপরের ধাপে উঠতে হলে যে প্রযুক্তি ও অবকাঠামো দরকার, তা না থাকায় উচ্চমধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের স্থিতাবস্থা বিরাজ করে, যাকে মধ্যম আয়ের ফাঁদ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

মধ্যম আয়ের দেশে থাকা অবস্থায় সস্তা শ্রমনির্ভর পণ্য বিক্রি করে যে দেশ আয়ের উচ্চধাপে প্রবেশ করে, সে দেশই শ্রমের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় সে পণ্য কিংবা উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য উৎপাদন করতে না পারায় উচ্চ আয়ের ধাপে প্রবেশ করতে পারে না। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর অনেক দেশ এ রকম অবস্থায় আটকে আছে। তবে মধ্যম আয়ের ফাঁদের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে জনসংখ্যার ওপর নির্ভর করছে। যে দেশের জনসংখ্যা বেশি সে দেশের জনপ্রতি আয় বাড়ানো অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব। সে পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে চীন, যার জনসংখ্যা ১৪২ কোটি ৫৭ লাখ। মার্কিন ডলারের ভিত্তিতে চীন দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হলেও মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে এর অবস্থান অনেক পেছনে। এমন অবস্থা ভারতের জন্যও প্রযোজ্য হবে। মধ্যম আয়ের ফাঁদ ছিন্ন করা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি। প্রসঙ্গক্রমে আসতে পারে কাকে অনুসরণ করা যায়? দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্য বিশ্লেষণ করলে যে কয়েকটি বিষয় সামনে চলে আসে তা হলো রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, যা মূলত ১৯৬১ সালের পর শুরু হয়। কারণ সামরিক শাসক জেনারেল পার্কের মতে, সরকার ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্তৃত্ব ও সক্ষমতা নেই। কথাটি নব্য ক্ল্যাসিক্যাল দর্শনে বেমানান হলেও দক্ষিণ কোরিয়ার আজকের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সে সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়া রফতানিভিত্তিক মুক্ত বাণিজ্যের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছিল। যদিও অনেক ক্ষেত্রে দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করতে তখন আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হয়।

বাংলাদেশে শ্রম সস্তা, ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচ কম। অর্থাৎ পুঁজি লগ্নিকারীদের মুনাফা বেশি। এটাই আমাদের উচ্চপ্রবৃদ্ধির মোদ্দা কথা? এটাই বাংলাদেশের ইকোনমিক মিরাকলের রহস্য? তা যদি হয়, তাহলে সেটি টেকসই উন্নয়নের সহায়ক নয়। প্রধানত সস্তা শ্রমের ওপরে নির্ভরশীল এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নির্মম দিকটা লক্ষ করা প্রয়োজন। পণ্য উৎপাদনের খরচ কম হচ্ছে প্রধানত এ কারণে যে খুব সস্তায় শ্রম কেনা যাচ্ছে। মালিক যন্ত্র কিনছেন আন্তর্জাতিক বাজারদরে, কাঁচামাল কেনায় কিংবা জ্বালানির খরচেও তার সাশ্রয় করার সুযোগ তেমন নেই। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় খরচের যত খাত আছে, তার কোথাও খরচ করতে মালিকের কার্পণ্য দেখানোর সুযোগ নেই। আবার এ কথাও সত্য, বাংলাদেশের শ্রম উৎপাদনশীলতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে কম। বাংলাদেশে শ্রম এত সস্তা কেন? এজন্য যে আয়তনের তুলনায় এ দেশের জনসংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। এ দেশে এখন প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করছে ১ হাজার ২৬৫ জন। বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ চীন। সেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৪৮ জন বাস করে। জনসংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় দেশ ভারতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৩১ জনের বাস। বাংলাদেশে শ্রম এত সস্তা এ কারণে যে শ্রম বিক্রি করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে লিপ্ত মানুষের সংখ্যার তুলনায় কাজের ক্ষেত্র একেবারেই কম। অতি অল্প মজুরিতেও তারা কাজ করতে রাজি, কিন্তু কাজ নেই। 

একুশ শতকের পৃথিবীতে সস্তা শ্রমিকের ওপর নির্ভর করে উন্নয়নের উচ্চপর্যায়ে পৌঁছা সম্ভব নয়। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা, শ্রমিকদের দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধি এবং পোশাক কারখানায় কাজের পরিবেশ উন্নত করা প্রয়োজন। লক্ষণীয় যে আমাদের শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেশ নিচে, বিশ্বে নিম্নতম। তাই শ্রম সস্তা নিয়ে আমাদের বড়াই করলে চলে না—বলেছেন ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। যেখানে শ্রমের উৎপাদনশীলতা কম থাকে, সেখানে বাইরের লোক আসে না। আমাদের সমপর্যায়ের অর্থনীতি ভিয়েতনামে কিন্তু এ উৎপাদনশীলতা অনেক উঁচুতে। শ্রমের উৎপাদনশীলতার বিষয়টি যেকোনো দেশের উন্নতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কর্মক্ষম নাগরিকদের শ্রম দেয়ার ক্ষেত্রে যে দেশ যত বেশি উন্নতি করেছে, সেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন তত বেশি ত্বরান্বিত হয়েছে এবং বিশ্বায়নের ধাক্কা মোকাবেলায় সফল হয়েছে। এর কারণ শ্রমের উৎপাদনশীলতার সক্ষমতার সঙ্গে উন্নতি ও পণ্যের মূল্য সরাসরি সংশ্লিষ্ট। তাই বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে উন্নয়নকামী বেশির ভাগ দেশ তার নাগরিকদের শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশে শ্রমের উৎপাদনশীলতা কম কেন! এ বিষয়ে কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি খাতে ঘাটতি রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কাজে জবাবদিহিতা কম, সুশাসনে রয়েছে ঘাটতি, যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়নের অভাব—এমন আরো অনেক কারণ বিদ্যমান। এ অবস্থায় বিদ্যমান শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি দুরাশা। দক্ষ মানুষ নিয়ে চালিত দেশগুলো তার নাগরিকদের শ্রমের উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি অটোমেশন, রোবট, ড্রোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রভৃতিতে সম্ভাব্য সবই বিনিয়োগ করছে। ফলে তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ছে, পণ্যের মূল্যও বাড়ছে। বাংলাদেশ ইদানীং প্রযুক্তির গুরুত্ব বুঝতে পারছে, কিন্তু শ্রমের উৎপাদনশীলতায় এখনো অনেক পিছিয়ে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়বে, দেশের মানুষ তত বেশি বেকার হবে। বিদ্যমান বাস্তবতায় সস্তা শ্রমনির্ভর উন্নয়নের পথ থেকে বেরিয়ে দক্ষতা, উচ্চ উৎপাদনশীল ও জ্ঞাননির্ভর উন্নয়নের দিকে যাত্রা করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের পাশাপাশি কারিগরি জ্ঞানের প্রসার ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেয়া প্রয়োজন। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন