নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে সংসদীয় সাবকমিটি

নবায়নযোগ্য ছাড়া বিদ্যুৎ খাত টেকসই হবে না

২০৪১ সালের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এক যুগে দেশের বিদ্যুৎ খাতে অভাবনীয় সাফল্যের দাবি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে এ সফলতা এসেছে মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি প্রযুক্তির ওপর ভর করে। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে অন্য সব জ্বালানির মতোই সমান গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সন্তোষজনক অবস্থান তৈরি করতে পারেনি বাংলাদেশ। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সঠিক রূপরেখা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিতকরণ ও তা দূরীকরণে সংসদীয় সাবকমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতিবাচক উদ্যোগ, তবে কমিটি গঠনের সঙ্গে সঙ্গে অগ্রগতিরও মূল্যায়ন জরুরি। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশের সম্ভাবনা রয়েছে বেশ। কিন্তু সে অনুযায়ী অগ্রগতি অপেক্ষাকৃত ধীর। পুরো বিশ্ব টেকসই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমাধান হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা চলবে না। লক্ষ্য অর্জনে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। 

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ হিসেবে সৌরবিদ্যুতের পরিচিতিই বেশি। এ সৌরবিদ্যুৎ ছড়িয়েছে প্রধানত গ্রাম, মফস্বল ও চরাঞ্চলে। সোলার সিস্টেমের ওয়াটপ্রতি দাম যখন ৪৫০ কিংবা ৫০০ টাকা ছিল, তখন থেকেই এটি ব্যবহারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ সামাজিক গ্রহণযোগ্যতারই সাক্ষ্য দেয়। ফলে দ্রুততার সঙ্গেই বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ সোলার হোম সিস্টেমের ব্যবহার শুরু হয়েছে। অথচ কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুতের দাম বিশ্বব্যাপী ৭২ শতাংশ কমে গেলেও বাংলাদেশে এ বিদ্যুৎ নীতিনির্ধারণী মহলে মূল ধারার ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। আর ঠিক এ কারণেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পূর্বঘোষিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়নি। অন্যদিকে প্রযুক্তি আর চিন্তার অভিনবত্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিদ্যুৎ দিনকে দিন পরিণত হচ্ছে, অতিক্রম করছে সব বাধা। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার জন্য এখন রয়েছে ভাসমান সৌরপ্রযুক্তি, কৃষিজমিতে ফলন আর সৌরবিদ্যুৎ একসঙ্গে করার জন্য ‘সোলার শেয়ারিং’ আর বিকেন্দ্রীভূত গ্রিড ব্যবস্থাপনার মতো সমাধান। অন্য সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো সৌর কিংবা বায়ুবিদ্যুৎ করতে বিশাল এলাকা অধিগ্রহণের কোনো প্রয়োজন নেই। পতিত অকৃষিজমি, দখল হয়ে যাওয়া নদীর পাড় এবং বাড়ির ছাদের মতো স্থানে সোলার প্যানেল আর বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী এবং অগভীর সমুদ্র এলাকা বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য খুবই উপযোগী। সেই সঙ্গে সৌর আর বায়ুবিদ্যুতের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য রয়েছে দাম কমতে থাকা ব্যাটারির সুবিধা। এভাবে শিল্প, কৃষি আর ব্যবসা-বাণিজ্যে এ বিদ্যুৎ ক্রমেই নিজের দখল বাড়াচ্ছে। 

হতাশাজনক বিষয় হলো নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার দিক থেকে এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় পেছনে পড়ে আছে বাংলাদেশ। উৎপাদনে এগিয়ে থাকা দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, চীন ও মালয়েশিয়া। এশিয়ার মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে চীন। গত ১০ বছরে দেশটি মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি সক্ষমতা বাড়িয়েছে। বর্তমানে চীনের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১১ লাখ ৬০ হাজার ৭৯৯ মেগাওয়াট। ২০১৩ সালে চীনের মোট সক্ষমতার ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ। দক্ষিণ এশিয়ায় গত এক দশকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে ভারত। দেশটির মোট উৎপাদন সক্ষমতার ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ। বিশেষত সৌর, বায়ু ও হাইড্রো বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে দেশটিতে। এছাড়া মালয়েশিয়া মোট সক্ষমতার ২৩ দশমিক ৩, আফগানিস্তান ৬৪ ও ফিলিপাইন ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের সবচেয়ে বেশি সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। গত বছর এ খাত থেকে ২৯৫ গিগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। একই সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির খরচও কমেছে। দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের সক্ষমতা সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৯৬৬ মেগাওয়াট। সে হিসাবে বিদ্যুতের মোট উৎপাদন সক্ষমতায় এর অংশগ্রহণ মাত্র ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০০৮ সালে সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা ঘোষণা করে। সেই লক্ষ্য অনুযায়ী, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ২০১৫ সালে ৫ শতাংশ ও ২০২০ সালে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু তা অর্জন হয়নি।

নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের সক্ষমতা বাড়াতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। চলতি বছরের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগও রয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের। এরই অংশ হিসেবে দেশে বেশকিছু পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে জোর তদারকি চালানো হচ্ছে। এর আগেও গত এক দশকে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে নানা ধরনের পরিকল্পনা করে সরকার। তবে সেসব উদ্যোগ খুব বেশি বাস্তবায়ন হয়নি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যে কারণে এ খাত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। সংসদীয় সাবকমিটি এসব বিষয়ে কাজ করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। 

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বাধীন বিশেষজ্ঞ মহলের গবেষণাগুলোয় দেখানো হয়েছে, কোন উৎস থেকে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ কত টাকা বিনিয়োগে উৎপাদন সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলের প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদা নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকেই মেটানো সম্ভব; আর তাতে প্রতি বছর মাথাপিছু সাশ্রয় হবে ২ হাজার টাকা। কিন্তু এ সুলভ বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সর্বব্যাপী উদ্যোগ আর রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। প্রচলিত কোম্পানিভিত্তিক মডেলে অধিক ব্যবসায়িক মুনাফার নিশ্চয়তা আসতে পারে, কিন্তু তাতে কখনই সস্তা বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছবে না। আর ঠিক এ কারণেই কমতে থাকা সৌরবিদ্যুতের কালে এসেও বাংলাদেশের কোথাও কোথাও গ্রাহককে ইউনিটপ্রতি ৩০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে, যা কাম্য নয়। এতে গ্রাহক ও উৎপাদকরা অনুৎসাহিত হবেন। 

নিজস্ব উপায়ে সৌরবিদ্যুৎকে টেকসই করতে হবে। প্রান্তিক পর্যায়ে সেচ কৃষির কাজটি যদি সোলারের মাধ্যমে করা যায় তাহলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির অনিশ্চয়তা হলেও তা কৃষির ওপর প্রভাব ফেলবে না। আর শহরাঞ্চলের জন্য করতে হবে নেট মিটারিং পদ্ধতি। এখন যেসব বিদ্যুচ্চালিত বাহন গ্রামে চলে সেগুলো পুরোপুরি সৌরবিদ্যুতে নিয়ে গেলে চার্জ বাবদ মাসে বিপুল অর্থ সাশ্রয় হবে। এক্ষেত্রে সোলার যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক কমানো সময়ের দাবি। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য আগামী ১০ বছর কর রেয়াত সুবিধাসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়া বিনিয়োগকারীদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অকৃষিজ খাসজমি বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ও তহবিল গঠন করা যেতে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে টেকসই বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বিদ্যুতের ট্যারিফে যেন কোনো বৈষম্য না হয় সে নিশ্চয়তাও দিতে হবে। সংসদীয় সাবকমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম গতিশীল হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে নিয়মিত তদারকি ও লক্ষ্য অনুযায়ী কাজের অগ্রগতি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। 


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন