রফতানি বাজারে মন্দা

দুশ্চিন্তায় দেশের জিন্স উৎপাদনকারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশে পোশাক খাতের অন্যতম রফতানি পণ্য ডেনিম (জিন্স) কাপড় ও এতে তৈরি বিভিন্ন ধরনের পোশাক। পশ্চিমা (যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ) বাজারে একক জিন্স পণ্য সরবরাহকারী হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। এ খাতের ব্যবসায় দেশের উদ্যোক্তাদের বড় অংকের বিনিয়োগও রয়েছে। যদিও রফতানির বাজারগুলোয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসৃষ্ট মন্দা ও মূল্যস্ফীতির চাপ এখন বাংলাদেশে জিন্স উৎপাদনকারীদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে বাজারগুলোয় তাদের রফতানি কমে এসেছে। পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন না হলে সামনের দিনগুলোয় বিপত্তির মাত্রা বাড়বে বলে আশঙ্কা তাদের। 

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশী মালিকানাধীন ৪০টির মতো কারখানা এখন ডেনিম ফ্যাব্রিক্স উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। কারখানাগুলোর বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা আট কোটি গজ। এ খাতে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি টাকা।

এ বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ নিয়ে এখন শঙ্কা তৈরি করছে রফতানি বাজারগুলোর পরিস্থিতি। ২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের ডেনিম পণ্য রফতানি কমেছে ৩৩ শতাংশ। এ ব্যবসা কমার প্রভাব দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ডেনিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনেও।

দেশের শীর্ষ ডেনিম কাপড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে এনভয় টেক্সটাইলস লিমিটেড, শাশা ডেনিমস লিমিটেড ও আরগন ডেনিমস লিমিটেড। চলতি ২০২২-২৩ হিসাব বছরের (জুলাই-জুন) প্রথম তিন প্রান্তিকের (জুলাই-মার্চ) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ সময়ে কোম্পানি তিনটির আয় কমেছে। এর মধ্যে এনভয় টেক্সটাইলসের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ, শাশা ডেনিমসের ২৪ দশমিক ৭৭ এবং আরগন ডেনিমসের ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ আয় কমেছে। আয় করার পাশাপাশি এ সময়ে এনভয় টেক্সটাইলস ও শাশা ডেনিমসের কর-পরবর্তী নিট মুনাফাও কমে গেছে। তবে এ সময় আরগন ডেনিমসের নিট মুনাফা বেড়েছে। 

এনভয় টেক্সটাইলস ২০২২-২৩ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) ৮০৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা আয় করেছে। যেখানে এর আগের হিসাব বছরের একই সময়ে আয় ছিল ৮৮৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ২৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। যেখানে এর আগের বছরের একই সময়ে নিট মুনাফা ছিল ৩৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এদিকে চলতি হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) কোম্পানিটির ২৫৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা আয় হয়েছে। যেখানে এর আগের বছরের একই সময়ে আয় ছিল ৩৩৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এ তিন মাসে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১২ কোটি ৫৩ লাখ টাকায়। 

তালিকাভুক্ত আরেক ডেনিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান শাশা ডেনিমসের আয় ২০২২-২৩ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিক (জুলাই-মার্চ) শেষে ৬৫৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যেখানে এর আগের হিসাব বছরের একই সময়ে আয় ছিল ৮৭৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ১৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। যেখানে এর আগের বছরের একই সময়ে নিট মুনাফা ছিল ২০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এদিকে চলতি হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) কোম্পানিটির ১৯৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা আয় হয়েছে। যেখানে এর আগের বছরের একই সময়ে আয় ছিল ৩১০ কোটি টাকা। এ তিন মাসে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ৪৩ লাখ টাকা, যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকায়। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারজনিত লোকসান ও আয়কর বাবদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে মুনাফা কমেছে বলে স্টক এক্সচেঞ্জকে জানিয়েছে কোম্পানিটি।

জানতে চাইলে শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌কভিডের সময়ে দেয়া প্রণোদনা প্যাকেজের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মূল্যস্ফীতিতে আরেক দফায় ঊর্ধ্বমুখিতা দেখা যায়। এ কারণে মানুষ মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে অর্থ ব্যয় করছে বেশি। সে তুলনায় কাপড় কেনায় ব্যয় কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে ডেনিমের ক্রয়াদেশে। এছাড়া যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে মন্দার শঙ্কাও ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ দেয়ার গতিতে শ্লথ করে দিয়েছে। আরেকটি বিষয় ২০২১ সালের শেষের দিকে যখন তুলার দাম ঊর্ধ্বমুখী ছিল তখন ভবিষ্যতে আরো দাম বাড়তে পারে এ শঙ্কায় ক্রেতারা বাড়তি ক্রয়াদেশ দিয়েছিলেন। সেসব পণ্য তাদের স্টকে থেকে যাওয়ার কারণেও বর্তমানে ক্রয়াদেশ কমেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে এ মাস থেকে আবার ক্রয়াদেশ বাড়তে শুরু করেছে। এর প্রভাব বোঝা যাবে তিন-চার মাস পর।’

২০২২-২৩ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) আরগন ডেনিমসের আয় হয়েছে ৩১৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানিটির আয় হয়েছিল ৩৪০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর আগের বছরের একই সময়ে নিট মুনাফা হয়েছিল ৫৯ লাখ টাকা। 

নিট মুনাফা হলেও চলতি হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) কোম্পানিটির আয় হ্রাস পেয়েছে। এ সময় কোম্পানিটির আয় হয়েছে ১২৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। যেখানে এর আগের বছরের একই সময়ে আয় ছিল ১৪০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এ তিন মাসে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। রফতানি থেকে আয় কমে যাওয়ার কারণে তৃতীয় প্রান্তিকে মুনাফা কমেছে বলে স্টক এক্সচেঞ্জকে জানিয়েছে কোম্পানিটি।

আরগন ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডেনিম পণ্যের মধ্যে ট্রাউজার বেশি রফতানি হয়। এবার ট্রাউজারের বিক্রি অনেক কমে গেছে। ডেনিম নিয়ে যারা কাজ করছে তাদের ক্রয়াদেশ কম। আমি শুনছি, আগামী কয়েক মাসেও ক্রয়াদেশ নিম্নমুখী থাকবে।’

মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রয়াদেশ কমছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষ এখন খুব বেশি কাপড়-চোপড় কিনছে না। সব জায়গায় কিন্তু তা কমছে। বৈশ্বিকভাবে ক্রয়াদেশ ১৭ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে বেশি রয়েছে ট্রাউজার, তারপর অন্যান্য পণ্য। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় বাজার ওয়ালমার্টের। তাদের বিক্রি কমে গেছে। তাদের স্টকে থাকলে তারা তো আর নতুন ক্রয়াদেশ দেবে না। যার কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’ 

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ডেনিম রফতানি কমেছে বাংলাদেশের। মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ওটেক্সার হিসাব অনুযায়ী, চলতি ২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের ডেনিম রফতানি হয়েছে ১৩ কোটি ১৪ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১৯ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার ডলার। সে অনুযায়ী, বছরের প্রথম প্রান্তিকে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের ডেনিম রফতানি কমেছে ৩৩ শতাংশের বেশি। এর আগে ২০২২ সালজুড়ে মার্কিন বাজারে মোট ৯৪ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের ডেনিম রফতানি করেছে বাংলাদেশ। আগের বছর ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ৭৯ কোটি ৮৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। 

২০২০ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষ ডেনিম সরবরাহকারী দেশ বাংলাদেশ। ওটেক্সার হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক ডেনিম আমদানিও ছিল কমতির দিকে। এ সময় বিশ্ববাজার থেকে মোট ৬৬ কোটি ২৪ লাখ ৪০ হাজার ডলারের ডেনিম আমদানি করেছে দেশটি। আগের বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৯৬ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার ডলার। সে হিসেবে বছরের প্রথম প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের ডেনিম আমদানি কমেছে ৩১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। 

রফতানিকারকদের ভাষ্যমতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউভুক্ত দেশগুলো এখন অর্থনৈতিক শ্লথতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির বড় প্রভাবও বাজারে ডেনিমের চাহিদায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের ডেনিম রফতানির পরিসংখ্যানেও এ প্রভাব এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে সংকুচিত হচ্ছে, ডেনিম উৎপাদনকারীদের নিট মুনাফাও। সব মিলিয়ে বেশ চাপের মধ্যেই রয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। 

রফতানি কমেছে ইইউর বাজারেও। পোশাক খাতের উৎপাদন ও রফতানিসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকেই ইইউর বাজারে ডেনিমের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী বাংলাদেশ। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ইইউর বাজারে ডেনিম রফতানি করেছে ২৩ কোটি ৪০ লাখ ৬০ হাজার ডলারের। এ সময় তুরস্ক, পাকিস্তানসহ ইইউর অন্যান্য ডেনিম সরবরাহকারী দেশ থেকেও উল্লেখযোগ্য হারে রফতানি কমেছে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইইউর বাজারে ডেনিম রফতানি থেকে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ১৫৫ কোটি ডলার। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ১১৮ কোটি ডলার। 

প্যাসিফিক ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘আমাদের ক্রেতারা লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিক্রি করতে পারেনি। যার জন্য আমাদের ক্রয়াদেশ কমে গেছে। এ মৌসুমে যে পরিমাণ পণ্য কেনার কথা রয়েছে তারা আর তা কিনছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আগামী বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় লাগবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন