জ্বালানি সংকটে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র

আবু তাহের

দেশে ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা হাজার ২৭৮ মেগাওয়াট (মে, ২০২৩ পর্যন্ত), যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ২৬ শতাংশ। যদিও লোডশেডিংয়ের তীব্র চাপের মধ্যেও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এসব কেন্দ্র থেকে গতকাল বিদ্যুৎ নিয়েছে হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। উৎপাদন খরচ অধিক বিবেচনায় বিপিডিবি কম বিদ্যুৎ নেয়ার কথা জানালেও কেন্দ্রগুলো মূলত জ্বালানি সংকটে রয়েছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।

খাতের বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিপিডিপির কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর (আইপিপি) সাত মাসের বিল বকেয়া পড়েছে। এর পরিমাণ প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। ফলে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতে পারছেন না তারা। একইভাবে জ্বালানির অভাবে উৎপাদন সংকটে পড়েছে আড়াই-তিন হাজার মেগাওয়াটের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও। ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম, মেঘনাঘাট, হরিপুর সিদ্ধিরগঞ্জের অনেক বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। তাই সারা দেশে লোডশেডিং বেড়েছে ব্যাপক হারে।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ঘণ্টাপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন লোডশেডিংয়ের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বিকাল ৫টা পর্যন্ত দেশে বিদ্যুতের চাহিদা দেখানো হয় ১৩ হাজার মেগাওয়াট। এর বিপরীতে উৎপাদন হয় ১০ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি বিদ্যুৎ। জ্বালানি তেলভিত্তিক (এইচএফও) বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ছিল সময় হাজার ৪৩৬ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয় হাজার ৭০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। অথচ জ্বালানি তেলভিত্তিক প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে তখন বসিয়ে রাখা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো পুনরায় চালু না হওয়া পর্যন্ত এইচএফও কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যেত। তবে আগের বিপুল পরিমাণ বিল বকেয়া থাকায় সাম্প্রতিক দুই-তিন হাজার মেগাওয়াট ঘাটতিতেও বেসরকারি এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়নি বলে জানান বিপিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, উৎপাদন খরচ সাশ্রয়ী এমন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে সবসময় উৎপাদনে রাখা হয়। সেক্ষেত্রে খরচ বিবেচনায় এইচএফও কেন্দ্রগুলো থেকে কম বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে। আবার যখন বেশি নেয়ার প্রয়োজন পড়ছে তখন বেশি নেয়া হচ্ছে। তবে জ্বালানি সংকট এবং বকেয়া বিলের কারণে এইচএফও কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ না নেয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেননি।

বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ বিপিডিবির কাছে আইপিপির বকেয়া দীর্ঘদিনের। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থ ডলারের সংকট প্রকট হলে এর পরিমাণ আরো বাড়ে। আইপিপি উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বিপিডিবি গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের বকেয়া পরিশোধ করেছে। এরপর অক্টোবরের ৫০ শতাংশ বিল পরিশোধ করতে পারেনি। এরই মধ্যে আরো ছয় মাসের বিল বকেয়া পড়েছে।

অন্তত তিন আইপিপি উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাসে বিপিডিবির কাছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার (প্রতি মাসে গড়ে হাজার কোটি টাকা) মতো পাওনা রয়েছে আইপিপিগুলোর। বিপুল পরিমাণ বিল বকেয়া থাকায় বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর অনেকেই জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না। অনেকে কেন্দ্রের পরিচালন ব্যয় না মেটানোর পাশাপাশি ব্যাংকের ঋণখেলাপির ঝুঁকিতেও পড়েছেন।

বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্যোক্তা কনফিডেন্স পাওয়ার হোল্ডিংস লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমানে এইচএফও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ অর্থ না পাওয়ায় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতিতে বিপিডিবির বিদ্যুৎ চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন অসম্ভব। এদিকে দীর্ঘসময় ধরে বিল বকেয়ার কারণে আইপিপিগুলোর অনেকেই ঋণখেলাপির সম্মুখীন হচ্ছে।

বিপিডিবির কাছে বিপুল পরিমাণ বকেয়া আটকে থাকার কারণে অর্থ সংকটে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন ডরিন পাওয়ার জেনারেশনস অ্যান্ড সিস্টেমস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোস্তফা মঈন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের ছয় মাসেরও বেশি বিল বকেয়া রয়েছে বিপিডিবির কাছে। কারণে চলতি মূলধনে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ফলে আমরা চাহিদা অনুসারে জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারছি না। এতে পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনও সম্ভব হচ্ছে না। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণেও আমাদের বড় অংকের লোকসান হয়েছে। ভবিষ্যতেও লোকসানের সম্ভাবনা রয়েছে। তা সত্ত্বেও বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরো সক্ষমতায় কেন্দ্র চালাতে চেয়েছি। কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে জ্বালানি আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছি না।

বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এইচএফও বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ পড়ছে ১৩ টাকার মতো। আর এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় সারা বছর চললে বছরে জ্বালানি তেলের প্রয়োজন পড়ে ৫০ লাখ টন। চলতি অর্থবছরেও সে পরিমাণ জ্বালানি আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু অর্থ ডলার সংকটের কারণে সাড়ে তিন লাখ টনের বেশি আমদানি সম্ভব নয়।

এদিকে কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে মহেশখালীর দুটি ভাসমান টার্মিনাল থেকে গত শুক্রবার রাত ১১টা থেকে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এতে জ্বালানি সংকটে পড়েছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। এতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই লোডশেডিং বেড়েছে। সংকটের মধ্যেও এইচএফও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের চাপ নেই বলে জানিয়েছেন আইপিপির শীর্ষ নেতারা। বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র মালিকদের সংগঠন ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ফয়সাল করিম খান বণিক বার্তাকে বলেন, এইচএফও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ওপর প্রেসার নেই। কম মূল্যে এলএনজি আমদানি হওয়ায় চাপটা কম। তবে বকেয়া বিলের অবস্থা বেশি ভালো নয়।

দেশের আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কেনার একক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান বিপিডিবি। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বকেয়া, বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিস্থিতি এবং এইচএফও কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়ে জানতে বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমানের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি সাড়া দেননি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন