করোনারি এনজিওগ্রাম

ভয় নাকি আশার আলো

ছবি: অর্কিড মেডিকেল সেন্টার

মোর্শেদ আহমেদের বয়স ৫৫। ঢাকায় কাপড়ের ব্যবসায়ী। হঠাৎ দুপুরে প্রচণ্ড বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ইসিজি করে জানা গেল এটা অ্যাসিডিটির ব্যথা নয়। এটা হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা। চিকিৎসক তাকে সিসিইউতে (করোনারি কেয়ার ইউনিট) ভর্তি রেখে করোনারি এনজিওগ্রামের (সিএজি) পরামর্শ দিলেন। কিন্তু মোর্শেদ ও তার পরিবার এনজিওগ্রামের কথা শুনে চিন্তায় পড়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকের মাধ্যমে আশ্বস্ত হয়ে উনারা এনজিওগ্রাম করেন। এতে তার রক্তনালিতে দুটি ব্লক ধরা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে এনজিওপ্লাস্টি বা রিং পরিয়ে দিয়ে ব্লকগুলো উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। মোর্শেদ আহমেদ এ যাত্রায় বুকে ব্যথা ছাড়াই চার-পাঁচদিন হাসপাতালে থেকে হাসিমুখে বাড়ি ফেরেন। মোর্শেদের মতো অনেকেই এনজিওগ্রাম নিয়ে ভুল ধারণায় হৃদরোগের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ‘‌করোনারি এনজিওগ্রাম’ হচ্ছে এক ধরনের রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, যার মাধ্যমে এক্স-রে ও কনট্রাস্ট মিডিয়া বা ডাই দিয়ে হার্টের রক্তনালির প্রবাহে কোনো বাধা বা ব্লক আছে কিনা নির্ণয় করা হয়। হার্টের ব্লক নির্ণয়ে করোনারি এনজিওগ্রাম হলো গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড বা যুক্তিসংগত পরীক্ষা পদ্ধতি। 

যেসব কারণে আমরা করোনারি এনজিওগ্রাম করি ১. হার্ট অ্যাটাক, ২. অ্যানজাইনা, ৩. ইটিটি পজিটিভ হলে, ৪. হার্টের ভালভ অপারেশনের আগে, ৫. জন্মগতভাবে হার্টের সমস্যার অপারেশনের আগে ইত্যাদি। 

এনজিওগ্রাম প্রক্রিয়া: এনজিওগ্রাম করার জন্য প্রয়োজন ক্যাথল্যাব। এখানে সি-আর্মস (এক ধরনের এনজিওগ্রাফি এক্স-রে) দিয়ে ও  আয়োডিন ডাই ব্যবহার করে হার্টের রক্তনালির বিভিন্ন অবস্থানের ছবি তোলা হয়। এক্ষেত্রে ফিমোরাল (পায়ের ধমনি) বা রেডিয়াল (হাতের ধমনি) আর্টারিতে পাংচার করে ক্যাথেটার প্রবেশ করানো হয়। বলে রাখা ভালো এনজিওগ্রামের সময় রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করা হয় না, শুধু পাংচারের স্থানে ব্যথানাশক ইনজেকশন দেয়া হয়। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে ডায়াবেটিস রোগী (অনিয়ন্ত্রিত), বয়স ৭০ বছরের বেশি, কিডনি রোগী বা হার্ট ফেইলিওরের রোগীদের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা হয়। দরকার হলে বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হয়। 

পরীক্ষার আগে কিছু সতর্কতা: দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য রোগীর কিছু ফিটনেস পরীক্ষা করানো হয়। যেমন সিবিসি, ব্লিডিং টাইম, ক্লটিং টাইম, এইচবিএসএজি (হেপাটাইটিস বি ভাইরাস পজিটিভ), এইচআইভি (হিউম্যান ইমিউনো ডিফেশিয়েন্সি ভাইরাস), ক্রিয়েটিনিন ইত্যাদি করানো হয়। সাধারণ এনজিওগ্রামের অন্তত ৪ ঘণ্টা আগে থেকে খাবার গ্রহণে বিরত থাকতে বলা হয়। 

পরিশেষে বলা যায়, এনজিওগ্রাম করে রোগী জানতে পারবে তার হার্টের চিকিৎসা কোনভাবে হবে। এটা কি ওষুধে সারবে নাকি রিং বা বাইপাস সার্জারি লাগবে। এতে হার্টের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা থেকে রোগী খুব দ্রুত মুক্তি পাবেন।

এক প্রকার রেডিও ওপেক ডাই ব্যবহার করে রক্তনালির (ধমনির) এক্স-রেকেই এনজিওগ্রাম বলা হয়। এই এনজিওগ্রাম বিভিন্ন অঙ্গের রক্তনালি দেখার জন্যই ব্যবহার করা হয়। যেমন ব্রেইনের ক্ষেত্রে সেরিব্রাল, হার্টের ক্ষেত্রে করোনারি, ফুসফুসের ক্ষেত্রে পালমোনারি আবার কিডনির ক্ষেত্রে রেনাল এনজিওগ্রাম বলে থাকি। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত হচ্ছে করোনারি এনজিওগ্রাম। করোনারি এনজিওগ্রামের মাধ্যমে আমরা হার্টের রক্তনালিগুলো ভালোভাবে দেখে নিতে পারি। যেকোনো বয়সের রোগীদের এনজিওগ্রাম করা হয়। 

হার্টের করোনারি এনজিওগ্রাম করা হয় সাধারণত হাত ও পায়ের রক্তনালি দিয়ে। ১০ মিলি লোকাল অ্যানেসথেটিক এজেন্ট সাধারণত হাতের বা পায়ের রক্তনালির স্থানে দেয়া হয়। এরপর একটা ক্যাথেটার হাতের রক্তনালি (সাধারণত রেডিয়াল ধমনি) ও পায়ের রক্তনালিতে (ফিমোরাল ধমনিতে) ঢোকানো হয়। এরপর আয়োডিনসমৃদ্ধ এক প্রকার রেডিও ওপেক ডাই ক্যাথেটারের মধ্য দিয়ে হার্টের রক্তনালিতে পাঠানো হয় এবং রক্তনালির সুন্দর প্রতিচ্ছবি এক্স-রেতে ভেসে ওঠে। এরপর রক্তনালির এ প্রতিচ্ছবি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় রক্তনালিতে কোনো ব্লক আছে কিনা এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে রক্তনালিতে রিং (স্টেন্ট) লাগবে কিনা অথবা বাইপাস সার্জারি (সিএবি) করতে হবে কিনা।

আমাদের হার্টের প্রধান দুটি রক্তনালি আরসিএ ও এলসিএ। এলসিএ পুনরায় বিভক্ত হয়ে এলএডি ও এলসিএক্স নামে এ রক্তনালিগুলো থাকে। এনজিওগ্রামে বিভিন্ন ভিউ ব্যবহার করা হয়। কারণ একটি মাত্র ভিউতে সব রক্তনালি ভালো বোঝা যায় না। একেকটি ভিউ দিয়ে এককটি রক্তনালি ভালোমতো দেখা যায়। কখন আমরা একজন রোগীর ক্ষেত্রে করোনারি এনজিওগ্রাম করব? যখন একজন রোগীর করোনারি হার্ট ডিজিজের (সিএইচডি) উপসর্গ দেখা যায়, যেমন বুকে ব্যথা, হাঁটতে গেলে ঘামে বা কষ্ট হয় তখন এনজিওগ্রাম করা হয়।

নিম্নোক্ত রোগের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত এনজিওগ্রাম করে থাকি। অ্যাকিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, আনস্ট্যাবল এনজিনা বা অস্থির এনজিনা (বুকে ব্যথা), ভেন্ট্রিকুলার অ্যারিথমিয়া (অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন), রোগীর যদি ভালভিউভার হার্ট ডিজিজেস থাকে, কার্ডিয়াক ট্রান্সপ্লান্টের পর ফলোআপেও আমরা এনজিওগ্রাম করে থাকি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা রোগীর এনজিওগ্রাম থেকে বিরত থাকব। যেমন: রোগীর দেহে রক্তনালির রোগ কোয়াগুলোপ্যাথি (রক্তক্ষরণ), জ্বর, কিডনি ফেইলিউর, ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালান্স, অ্যারিথমিয়া, অ্যাকটিভ সিম্পটমিক কোনো ইনফেকশন, অ্যালার্জি যদি থাকে।

এনজিওগ্রাম একটি পরীক্ষা পদ্ধতি। এটা কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি না। এটি হাসপাতালের যেকোনো স্থানে বসে করা যাবে না। এর জন্য উপযুক্ত একটি ক্যাথল্যাব লাগবে এবং রোগীর পরবর্তী ফলোআপ দেয়ার জন্য একে সম্পূর্ণ অত্যাধুনিক সিসিইউতে রাখতে হবে। কারণ করোনারি এনজিওগ্রাম করার পর অনেকগুলো সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন: হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, অ্যারিথমিয়া, অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন ডাইয়ের জন্য, যে রক্তনালিতে ক্যাথেটার ঢোকানো হয়েছিল সেখানে ক্ষত হতে পারে। কিডনি ফেইলিউর হতে পারে। এছাড়া ব্লিডিং ও ইনফ্লেম হতে পারে। 

এ পরীক্ষার অন্যতম সুবিধা হলো রোগীকে হাসপাতালে একদিনের বেশি থাকতে হবে না। এ একটি পরীক্ষা আমাদের দেশের হাজার হাজার মানুষের জীবন রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

লেখক: ডা. মাসুদ আহমেদ, ডা. গোপাল শীল ও ডা. বনি ইয়ামিন খান

কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইসিভিডি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন